মশলার নানান ঔষধি গুণ
হলুদ, জিরা, দারুচিনি এগুলো আমাদের কাছে খুবই পরিচিত শব্দ, যা আমরা মশলা নামে ডাকি। আমাদের দৈনন্দিন খাবার তৈরিতে বড় একটা অংশ জুড়ে ব্যবহার হয় বিভিন্ন ধরনের মশলা। এই মশলা-ই এনে দেয় খাবারে স্বাদ।
তবে শুধু স্বাদ বাড়াতেই নয় মশলার রয়েছে ঔষধি গুন-ও। নানান ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার হয় মসলা। প্রাচীনকাল থেকে ঔষধি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এই মশলা।
তবে অনেকে বলে থাকে যে বেশি মসলাদার খাবার খাওয়া ভালো না। এটা ঠিক অতিরিক্ত তেল মশলা দেওয়া খাবার শরীরের ক্ষতি করে৷ কিন্ত্ত এই মশলা গুলিই সহজপাচ্য করে রেঁধে খেলে, শরীরের কোনও ক্ষতি তো হয়ই না, বরং শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্যও করে৷
আসুন জেনে নেয়া যাক কিছু মশলার গুনাগুন সম্পর্কেঃ
হলুদঃ
প্রথমেই বলা যাক হরুদ এর কথা। খাবারে হলুদ এর ব্যবহার সবাই দেখেছি। কিন্তু এর যে এত উপকারিতা রয়েছে তা কি জানা আছে? মসলার জগতে হলুদের রয়েছে নানা গুণাবলি। হলুদ মূলত আদা গোত্রীয় পরিবারের সদস্য, সঙ্গে গাছের শিকড় থেকে প্রাপ্ত এক ধরনের মসলা। রান্না এবং ওষুধের পাশাপাশি রূপচর্চার ক্ষেত্রেও বেশ সুপরিচিত। হলুদের মধ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ লবণ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, লোহা প্রভৃতি নানা পদার্থ রয়েছে। যার ফলে হলুদ খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
কাঁচা হলুদের নানা ব্যবহার রয়েছে ত্বকের যত্নে। অন্যদিকে ঔষধ হিসাবেও যেমন হজমে যাদের সমস্যা আছে তারা অনায়াসে হলুদ খেতে পারেন।স্থূলতা বাড়াতে থাকা টিস্যুর গ্রোথ কমিয়ে আনতে সহায়তা করে এ মসলাটি।
এ ছাড়া ত্বকের বলিরেখা, কালো দাগসহ ত্বকের রুক্ষতা কমাতে হলুদ বেশ কার্যকর। অন্যদিকে কোথাও কেটে গেলে নিয়মিত হলুদ খেলে তা দ্রুত রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে। এ ছাড়া শরীরের নানা ধরনের ব্যথা কমাতেও হলুদ বেশ কার্যকর। এছাড়াও দুধে হলুদের এক চিমটি মিশ্রণ আপনার ত্বকের জন্য বেশ উপকারী।
জিরাঃ
জিরা হলো আরেকটি ঔষধিগুণ সম্পন্ন মসলা। জিরা অ্যাজমার সমস্যা কমায়, বাড়ায় ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য। আবার হজমক্ষমতাও বাড়ায় জিরা। পেটে ব্যথা কমাতেও এটি দারুণ কার্যকরী। জিরার আছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি প্রপাটিজ যা ঠান্ডা লাগা বা জ্বরের প্রকোপ কমাতে কাজ করে। এই প্রকৃতিক উপাদানরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে আছে প্রচুর ফাইবার, যা অনেকগুলো এনজাইমের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জিরা খেলে তা পাইলসের কষ্ট কমাতেও সাহায্য করে। এছাড়াও ওজন কমাতে বেশ সাহায্য করে জিরা। গরম পানিতে জিরা ও লেবু মিক্স করে খেলে তা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
আজওয়াইনঃ
আজওয়াইনে আছে এমন কিছু উপকারী উপাদান, যা শরীরকে সুস্থ রাখতে নানা ভাবে সাহায্য করে থাকে। বিশেষ করে হজম ক্ষমতা বাড়াতে, ওজন ধরে রাখতে, ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়াতে এবং ত্বক-চুলের যত্নে আজওয়াইনের কোনও বিকল্প নেই। এতে আছে ফাইবার, প্রোটিন, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস। থাকে ল্যাক্সাটাইভস। যা আমাদের কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে হজমের সমস্যায় সাহায্য করে। সেই সঙ্গে মেটাবলিজম রেটও বাড়ায়। যার ফলে ওজন কমাতে এটি সাহায্য করে থাকে।
কালিজিরাঃ
কালিজিরার স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিসীম। এটি
একটি অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিসেপটিক। এটি মস্তিস্কের রক্ত সঞ্চলন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মরণ শক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। এতে থাকেপ্রোটিন ২০৮ মাইক্রোগ্রাম,ক্যালসিয়াম ১.৮৫ মাইক্রোগ্রাম, আয়রন ১০৫ মাইক্রোগ্রাম, ফসফরাস ৫.২৬ মিলিগ্রাম, কপার ১৮ মাইক্রোগ্রাম, জিংক ৬০ মাইক্রোগ্রাম।
কালিজিরা খেলে আমাদের দেহে রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হয়। এতে করে মস্তিস্কের রক্ত সঞ্চলন বৃদ্ধি হয়, যা আমাদের স্মৃতি শক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। এছাড়াও সপ্তাহে ২/৩ বার কালিজিরার তেলের সঙ্গে মধু মিক্স করে খেলে মাথা ব্যাথা হয় না। কালিজিরা খেলে জ্বর, ব্যথা, সর্দি-কাশি দূর হয়। সর্দি বসে গেলে কালিজিরা বেটে কপালে প্রলেপ দিন উপকার পাবেন অনেক। হার্টের সমস্যা সমাধানেও কালিজিরা খুব উপকারী। যারা হাঁপানী বা শ্বাসকষ্ট জনিত সমসসায় ভুগে থাকেন তাদের জন্য কালিজিরা অনেক বেশি উপকারী। প্রতিদিন কালিজিরার ভর্তা রাখুন খাদ্য তালিকায়। এটি হাঁপানি বা শ্বাস কষ্টজনিত সমস্যা উপশম হবে। ডায়াবেটিকদের রোগ উপশমেও বেশ কাজে লাগে কালিজিরা। এক চিমটি পরিমাণ কালিজিরা এক গ্লাস পানির সঙ্গে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেলে, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
দারুচিনিঃ
দারুচিনি খাবারে সুগন্ধি এনে দেয়ার ব্যাপারে বেশ পরিচিত। এর পাশাপাশি পুষ্টিগুণের দিকে থেকেও বেশ এগিয়ে এই মসলা। ক্যালোরি, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ছাড়াও অ্যান্টি অক্সিডেন্টের উৎস দারুচিনি।
দারুচিনিতে পলিফেনল নামক উদ্ভিদ যৌগ রয়েছে যার প্রতিরক্ষামূলক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দারুচিনি অনেক ঔষধি গুণ রয়েছে। এতে সিনামালডিহাইড নামক একটি উপাদান আছে যা ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ঠান্ডা-কাশি উপশম করতে সাহায্য করে এই মসলা।
ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক সাহায্য করে দারুচিনি।রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইডের পাশাপাশি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে দারুচিনি। ফলে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমে যায়। দাঁতের সমস্যাও দূর করতে পারে দারুচিনি। দাঁতের ব্যথা এবং মুখে ব্যাকটেরিয়ার অতিরিক্ত বৃদ্ধি এবং নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ থাকলে দারুচিনি খেলে উপকার পাওয়া যায়।
জায়ফলঃ
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে চাইলে সবচেয়ে বেশি উপকার করবে আপনাকে জায়ফল। এর পাশাপাশি আরও বহু গুণ আছে এই মশলার। এতে আছে ৩৬ গ্রাম ফ্যাট, ৩৯ গ্রাম কার্ব, ৬ গ্রাম প্রোটিন, ভিটামিন সি, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম। এক কাপ গরম দুধের সঙ্গে এক চা চামচ মধু, কিছুটা এলাচ গুঁড়া আর ২ চিমটে জায়ফল গুঁড়ো দিয়ে দিন। প্রতি দিন দুধের এই মিশ্রন খেলে আপনার রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়বে। এছাড়াও যে কোনও ধরনের ব্যথা কমাতে, হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটাতে, অনিদ্রার সমস্যা দূর করতে এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়াতে এটি নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং বাতকে উপশম করতে কার্যকর।
জাফরানঃ
সবচেয়ে দামি মসলা হলো এই জাফরান। এর দাম এমনিতেই এত বেশি না, এর রয়েছে অনেক গুণাগুণ। জাফরান হল পুষ্টির ভান্ডার৷ জাফরানে ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক,পটাসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, প্রোটিন, ডায়েটারি ফাইবার, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন এ, সি, বি৬, ফসফরাস, কার্বোহাইড্রেট, প্রদাহরোধী, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ইত্যাদির ভাল উৎস।
জাফরান খেলে ঠান্ডা, হৃদরোগ, পেট সংক্রান্ত সমস্যা, অনিদ্রা, জরায়ুতে রক্তপাতের মতো সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়।
এতে অনেক ধরনের উদ্ভিদ যৌগ রয়েছে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এগুলি শরীরের কোষগুলিকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং ফ্রি ব়্যাডিকেল থেকে রক্ষা করে। জাফরানে রয়েছে হাইড্রোলকোহলিক নির্যাস, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা উন্নত করতে পারে। এটি টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে পারে। জাফরান খেলে ত্বক ও চুলের জন্যও উপকারী। জাফরানে উপস্থিত দুটি প্রধান ক্যারোটিনয়েড, ক্রোসিন এবং ক্রোসেটিন, যার ফলে এর টিউমার প্রতিরোধী প্রভাব রয়েছে। এটি খেলে কোলোরেক্টাল ক্যানসার, প্রোস্টেট ক্যানসার এবং স্কিন ক্যানসারের কোষের বৃদ্ধি রোধ করে, যা এই বিপজ্জনক রোগ হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে।