মাতৃত্ব বনাম চাকরি
গৃহিণীকে হয়তো অনেকে পেশা বলতে পারেন। তবে মাতৃত্বকে কি ঠিক পেশা বলা যায়া? আপাতত না। সে সুযোগ নেই। মাতৃত্ব নারীর সহজাত বিষয়। সমস্যা হলো সামাজিক নর্ম অনুসারে মনের অজান্তেই কেন যেন আমরা মাতৃত্ব ও কর্মজীবী নারীর অস্তিত্ব একসাথে দেখতে অভ্যস্ত নই, অথবা দেখতে চাই না। এক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে অনেকে ভাবেন নারী সুবিধাবাদি। ম্যাটারনাল লিভের ছুটোয় হয় মাস বসে থাকবে। এমন স্টেরিওটাইপ ধারনা তো অমূলক নয়। মনের অজান্তেই আমাদের অনেকেই নারীর পরিচয়ের সঙ্গে জুড়ে দেই তার অবস্থা। একজন কর্মজীবী নারীর মধ্যে তৈরি করি তার মাতৃত্ব ও সেশার দ্বন্দ্ব। এই হব এবং দ্বন্দ্বময় কথা ও আচরণ একজন মাকে করে তোলে সন্তানের প্রতি মানসিকভাবে দুর্বল ও কর্মস্থলে অস্থির। আধুনিক এই যুগে এমন বিষয় সত্যিই দুঃখজনক।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব সেন্ট লুইস পরিচালিত এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, একজন কর্মজীবী মা তার অন্যান্য যেকোনো সন্তানহীন সহকর্মী অপেক্ষা বেশি কর্মদক্ষ।
একজন মা ধিনি নয় মাস তার সন্তানকে এতো ধৈর্য্য সহকারে গর্ভে ধারণ করেন এবং অপরিসীম কষ্ট করে জন্ম দেন, কর্মক্ষেত্রে তিনি কী পরিমাণ ধৈর্য্যশীলতা ও কষ্টসহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে পারেন তা এখান থেকে সহজেয় অনুমেয়। কারণ কর্মক্ষেত্রে নারীকে অনেক সময় জীবনের তাগিদেই যুক্ত হতে হয়। মা হাজারও কর্মব্যস্ততার মাঝেও সন্তানের ছোট থেকে ছোট প্রয়োজনগুলোও ভুলেন না, তিনি করোটি দায়িত্বশীলভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন, তা বলাই বাহুল্য।
কর্মজীবী নারী ও তার মাতৃত্ব পরস্পর প্রতিযোগী কোনো বিষয় নয়। আমাদের বরা ভাবতে হবে নারীর দুই পরিচয়ই অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত। নারী তার সন্তান এর প্রতি যেমন দায়িত্ব পালন করতে পারে, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারে। পরোক্ষভাবে সমাজের এবং প্রত্যক্ষভাবে আমাদের কিছু ভুল মানসিকতার কারণে আমাদের বহু কর্মজীবী মা হয় তার কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে, নয়তো পেশাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সন্তানকে কাছে না পাওয়ার হচ্ছে জর্জরিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে যেমন মনে করা হচ্ছে মা হওয়া মানেই নারীর কর্মদক্ষরা কমে যাওয়া এবং এই মানসিকতার কারণে প্রতি পদে পদে কর্মদক্ষ নারীটিকে পূর্বের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হচ্ছে, কর্মোয়তি ধীর হয়ে যাচ্ছে, কাজের বিভিন্ন ধাপে থাকে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে বলে দেওয়া হচ্ছে যে যেহেতু সে একজন মা, তাই এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হয়তো সে সম্পন্ন করতে পারবে না।
কর্মক্ষেত্রে এই অবহেলা যেমন দেখি একজন কর্মজীবী মা’র প্রতি, তেমনি আরেক সমস্যাও আছে যেখানে দেখা যায় কর্মজীবী মাকে অতিরিক্ত কাজের চাপ চাপিয়ে দেয়া এটা মনে করে যে সেই নারীটি সেই মুহূর্তে শুধুমাত্র নিজের কর্মদক্ষতা প্রমাণের জন্য যেকোনো কাজ যা হয়তো তার করার কথা না তাও করবে। কেন করি আমরা এই আচরণগুলো? যে মুহূর্তে সেই কর্মজীবী মাটির প্রয়োজন একটু আত্মবিশ্বাস ও অভিযোজন, ঠিক সেই মুহূর্তেই কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠে তার জন্য প্রতিকূল। এই প্রথাগত আচরণ কি নারীর পেশাগত পরিচয়ের প্রতি নির্যাতন নয়? তাকে মনে করিয়ে দেয়া নয় যে সে একজন নারী, সুতরাং কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের দে যোগ্য নয়? কেন একই পরিমাণ যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও একজন পুরুষ অপেক্ষা একজন নারীকে কর্মক্ষেত্রে বারবার নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হবে? শুধু কর্মক্ষেত্র কেন, পরিবারেও মাকে পর্যাপ্ত সেবা ও মর্যাদা দেয়া হয় না। সন্তান জন্ম দেওয়ার সাথে সাথেই কি আমরা ভেবে নিচ্ছি না যে এখন এই সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব তার মার এবং পেশাটি হবে পরিবার কি এখনো ভাবতে শিখেছে যে, সন্তান ও পেশা এই দুই-ই নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এই দুটি ভূমিকা মোটেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নয়া একজন কর্মজীবী মা তার পেশাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তার মানে কি এই যে দে একজন ভালো মা নয়া সে তার সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল নয়? চারপাশের কর্মজীবী মাদের প্রতি একটু খেয়াল করে দেখুন তো একজন কর্মজীবী মা তার সন্তানের কোন প্রয়োজনটা পূরণের ব্যবস্থা না করে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছে? সমাজের প্রচলিত মানসিকতার বাইরে বের হয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখবেন একজন কর্মজীবী মা কতটা অতিরিক্ত চাপ নিজের উপর নিচ্ছে এই দুই পরিচয়কে সামাল দিতে গিয়ে।
অধিকাংশ মাকে একটি দ্বিধায় ফেলে দেয়া হয়। সে কি করবে, কি হবে তার পরিচয় ও অবস্থান। সন্তানের দায়িত্ব বাবা-মা দুজন ভাগ করে নিলে অনেক সহজেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কীভাবে কর্মজীবী মা তার পেশাগত দায়িত্ব ও সন্তানের প্রয়োজনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবেন, তা তা নিয়ে দোষারোপ বা সমালোচনা না করে সিদ্ধান্তটা কি সেই কর্মজীবী মা এবং তার জীবনসঙ্গী’র উপর-ই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়? পরিবারের একটু সহযোগিতা, একটু সহমর্মিতাই পরে একজন কর্মজীবী মাকে আশ্বস্ত করতে যে, তুমি এগিয়ে যাও কর্মক্ষেত্রে, আমরা আছি তোমার সাথে। মাতৃত্ব কখনই নারীর দুর্বলতা নয়, বরং সন্তানের জন্ম নারীকে করে তোলে আরও ধৈর্যশীল, দায়িত্বশীল এবং উদ্দীপনায় ভরপুর। একইভাবে পেশাগত দায়িত্ব কখনই ভালো মা হওয়ার পথে অন্তরায় নয়। তাই নারীর অগ্রযাত্রায় তার মাতৃত্বকে বাঁধা হিসেবে দাঁড় না করানোই উত্তম, কারণ মাতৃত্ব কিন্তু সব বাঁধা অতিক্রম করতে সক্ষম।