অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নারী
বহু শতাব্দী ধরে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমান সুযোগের জন্য সংগ্রাম করে আসছে নারী। যুগে যুগে নানা চ্যালেঞ্জ, বৈষম্য, সহিংসতা এবং সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে আপোসহীনভাবে দাঁড়িয়েছে তারা। এই সংগ্রাম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মুক্তির লড়াই নয়, পুরো সমাজের উন্নতি এবং ন্যায়ের পক্ষে এক অবিচ্ছেদ্য আন্দোলন।
আজকের বাঙালি নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার ভোগ করছে, তবে সমাজ বাস্তবতার কারণে এখনও নানা ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের। কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে, এবং সমাজে নারীরা যেসব বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছেন, সেগুলোর মধ্যে অনেক কিছুই পুরনো সমাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলস্বরূপ। ধর্ষণ, সহিংসতা, পারিবারিক নির্যাতন, কর্মস্থলে বৈষম্য—এই সব কিছুই নারীদের জীবনে প্রতিনিয়ত চাপ তৈরি করে চলছে। আজকাল নারীরা কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল হলেও, তাদেরকে এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। বিশেষত, কর্মক্ষেত্রে তাদেরকেও পুরুষদের মতো কাজের সুযোগ, সমান মজুরি, এবং সম্মান প্রাপ্য হওয়া সত্ত্বেও প্রথাগত বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়া যায়নি। এছাড়াও দেশের অনেক অঞ্চলে এখনও পরিবারিক এবং সামাজিক কুসংস্কার নারীদের বধ্য করে রাখে, যেখানে নারীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া বা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের নারীরা তাদের অধিকারের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রাম করে আসছেন। একদিকে, শোষণ, বৈষম্য ও সহিংসতার বিরুদ্ধে তারা তাদের কণ্ঠ তুলছেন, অন্যদিকে, নিজেদের শিক্ষিত ও সশক্ত করে তুলছেন। পটভূমি হিসেবে ধর্ম, সংস্কৃতি এবং পারিবারিক কাঠামো যেখানে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু সীমানা সৃষ্টি করেছে, সেখানে নারীরা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছে, বিক্ষোভ করছে এবং কখনো কখনো জীবন বাজি রেখে মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাদের দাবি জানাচ্ছে। এই দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি আমাদের অতীতের সকল অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে চব্বিশের গণঅভ্যুথ্যান—সবখানে তাদের সরব উপস্থিতি আন্দোলনকে বেগবান করেছে, বিজয়ের পথ সুগম করেছে।
শুধু জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দাবিতে নয়, বাঙালি মেয়েরা এখন নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চোর হচ্ছেন। আমাদের নতুন প্রজন্মের মেয়েরা নিজের অধিকার আদায়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সজাগ ও সচেতন। তারা শুধু নিজেদের স্বাধীনতার জন্য নয়, বরং সমাজে নারীদের সম্মানিত স্থান প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে। নারী উদ্যোক্তা, কর্মজীবী নারী, আইনবিদ, চিকিৎসক, রাজনৈতিক নেতা, প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা তাদের স্থান করে নিয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মও নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য শক্তিশালী এক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
তবে, নারীর অধিকার আদায়ের পথ কখনোই মসৃণ ছিল না এবং ভবিষ্যতেও তা সহজ হবে বলে মনে হয় না। এখনও সমাজের অন্ধকার কোণগুলোতে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, নির্যাতন এবং বৈষম্য বিদ্যমান। নারীদের জন্য আইনগত সুরক্ষা থাকলেও বাস্তবতায় সেগুলি কার্যকরভাবে প্রয়োগ হতে দেখা যায় না। মনে রাখতে হবে—নারীর অধিকার আদায়ের লড়াই শুধু তাদের একার সংগ্রাম নয়, বরং এটি পুরো সমাজের সংগ্রাম। নারীকে স্বাধীন, শক্তিশালী এবং সক্ষম করে তুলতে হলে প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ, সরকারের আইনগত পদক্ষেপ এবং সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তন। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীদেরকে সমান মর্যাদা, সুযোগ এবং স্বীকৃতি প্রদান করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের জন্য একটি সমান, সম্মানজনক পরিবেশ তৈরি করা, এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় পদে নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
নারীরা আজ জানে, তারা শুধু পরিবারের প্রতি নয়, পুরো সমাজ এবং দেশটির প্রতি এক বিশাল দায়িত্ব বহন করছে। এই অধিকার আদায়ের যাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত, নারীরা তাদের কণ্ঠস্বর উচ্চতর করবে, তাদের পদচারণা আরও দৃঢ় হবে।