নারীর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ কাজী নজরুলের সত্যবচন আজও সমাজে স্বীকৃতি পায়নি। এর দায় যতটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার, ততটাই নারীর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারও। মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অংশগ্রহণ। কিন্তু পুরুষ জাতি প্রতিনিয়ত বাহবা পেলেও নারীকে করা হয় অবরুদ্ধ, অবদমিত। ফলে নারীও শোষিত হতে হতে শোষণকেই যেন স্বাভাবিক জীবন বলে মেনে নিতে এবং মানিয়ে নিতে চায়। কখনো বা বাধ্য হয়।
নারীর জীবনযাপনে এঁকে দেওয়া হয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতার ছাপ। আধুনিক যুগে এসেও অনেক নারীই সেই শেকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেনি। যুগের পর যুগ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে অতি আপনার করে নারীরা লালন করে চলেছে। কিন্তু নারীর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রথমেই নারী জাতির বংশ পরম্পরা উল্লেখ্য। দাদি, নানি, মায়ের সংস্পর্শে নারীর গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা। ফলে আচার- আচরণ এবং সংস্কারে পুরোই নারীরা পূর্বজদের অনুসারী। ফলে বেশিরভাগ নারীর মননে আজও বাসা বেঁধে আছে সেই সব সংস্কার। যা তারা অগ্রজদের থেকে পেয়েছেন। তবে সময় পাল্টেছে। ঘটেছে জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন। তবু থেকে গেছে যুক্তিহীন কিছু নিয়ম-নীতির শোষণ। কিন্তু এগুলোর কী আদৌ কোনো ভিত্তি আছে?
প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের যুগে আমাদের বসবাস হলেও মানসিকতায় ছেঁয়ে আছে অযৌক্তিক কর্মের। যার সঙ্গে জীবনঘনিষ্ঠ কোন সংযোগ নেই। রয়ে গেছে নিছক মানসিকতায়। তবে এই নিছক মানসিকতায় মানুষের জীবনকে নরক করে দিতেও পিছপা হয় না। বিষয়টা যতটা চেতনার ঠিক ততটা বাঙালির মনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বীজকে চির সবুজ করে রাখা। এক্ষেত্রে বেশি দূরে যেতে হয় না আমাদের। ঘরের মধ্যেই এর বসতি এবং অশান্তির কারণও হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমেই নারীর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় বাসা বেঁধে আছে স্বামীর নাম ধরে ডাকা যাবে না এই বিষয়টি। এক্ষেত্রে অনেক নারীই আজও এটাকে কতটা যুক্তিহীন সে বিষয়ে নাক না গলিয়ে বরং একবাক্যে মেনে নেন। কারণ নারীরা ছোট থেকে মা, দাদিদের জীবনে এরূপ দেখে এসেছেন। ফলে তাদের মানসিকতায়ও বিষয়টি গেঁথে গেছে। কিন্তু যৌক্তিক ক্ষেত্রে স্বামীর নাম ধরে ডাকা কি অন্যায়? নাম তো একটি সম্বোধন শুধু। এর ফলে কারও কি কোনো ক্ষতি সাধন হয়? সন্তানের নাম ধরে ডাকা হয় তাকে নিদিষ্ট করে ডাকা এবং বোঝানোর জন্য। তাহলে স্বামীকে ডাকার ক্ষেত্রে নারীদের এতটা রাখঢাক কেন?
একজন নারী অন্য নারীকে ও এভাবে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। নারীর মানসিকতা সুস্থভাবে, সুস্থ বিকাশ ঘটুক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আজ্ঞাবহ না হয়ে যৌক্তিক জীবনে শিরদাঁড়া উঁচু করে বাচুক নারী। বিশ্বের বুকে গড়ে তুলুক আপন জগৎ।
নারীদের মনে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার আরেকটি বীজ স্বামীর নামকে নিজের নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। অনেকে নাম সংযুক্ত করার ফলে অনবদ্য ভালোবাসা অনুভব করেন। ব্যক্তিবিশেষে তা করতেই পারেন। কিন্তু মানসিকতার দিক থেকে নারীর মজ্জায় বসে আছে সেই ভূত। যা শুধু পুরুষের দাসত্বকেই মনে করায়। ভালোবাসা সর্বদাই পবিত্র। কিন্তু পবিত্র সম্পর্ক ক্ষেত্রবিশেষে শেষ হতেই পারে বা বিচ্ছেদ ঘটতেই পারে। এই কথা হয়তো অনেকেই মানবেন না, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। দুজনের মনের মিল, আচার-আচরণগত মিল, জীবনযাপন পদ্ধতি সব মেলা ভার। তারপরও দুটো ভিন্ন জায়গায় বেড়ে ওঠা মানুষ ভালোবেসে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এক ছাদের নিচে বসবাস করেন। কিন্তু জীবন চলার পথে যদি রদবদল হয় সেক্ষেত্রে দাম্পত্য সম্পর্কে আঘাত আসতে পারে। ভেঙেও যেতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কোনো সুনিশ্চিত সম্পর্ক নয়। বাবা-মা-ভাইয়ের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক। পৃথিবীর বিপর্যয় ঘটলেও সে সম্পর্ক ভেদ করার সাধ্য মানুষের নেই। কিন্তু নারীরা বাবার নামকে নিজ নামে সংযুক্ত করতে পারে। সেটার বিধান ধর্মেও বলা আছে। কিন্তু স্বামীর নাম কেন সংযুক্ত করেন? তার ভিত্তি কি দাসত্ব নয়?
পরিবারে বেড়ে উঠতে অনেক নারী সমাজের জালে এতটাই আবদ্ধ হয়ে পড়েন যে, তিনি নিজে একজন নারী সেটা ভুলে যান। তার গর্ভে একটি পুত্রসন্তান কামনা করেন। এর পেছনেও নারীর মগজে খেলা করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
নারীদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের খাওয়া নাহলে নারীরা খাবেন না। এক্ষেত্রে যৌক্তিক জীবন কতটা সায় দেয় এই বিধানের? বিভিন্নকারণে পুরুষের সঙ্গে নারীর দৈনন্দিন জীবনযাপনের রুটিন মিলতে না-ই পারে, তাই বলে এই মানসিকতা পোষণ করা কতটা যৌক্তিক? আশার কথা হলো, যুগের পরিবর্তনে নারীর এ ধরনের মানসিকতায় খানিকটা হলেও পরিবর্তন হয়েছে। তবে গ্রামাঞ্চলে আজও প্রথার বীজ রয়ে গেছে। কিন্তু নারীর মানসিকতা পরিবর্তন হওয়া কি অযৌক্তিক?
শুধু নারীর আগে খাওয়াটাই বাধাগ্রস্ত নয়। বরং বাড়ির সব কাজ যে নারীর সে মানসিকতা আজও এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি। ঘরের কাজ মানেই সব নারীর দায়। আর পুরুষের কর্মক্ষেত্র ঘরের বাইরে। এই মানসিকতা পুরুষ সম্পূর্ণরূপে আজও বয়ে বেড়াচ্ছে। তার সঙ্গী হয়েছে নারীও। যত কাজই থাক অনেকটা ভালোবেসে আর বেশিরভাগই দেখে দেখে অভ্যস্ত হওয়ার ফল। নারীর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করা উচিত।
স্ত্রী থেকে দূরে থাকলে পুরুষের কাজ সহজ হয়,পা দোলানো বা নাচানো, সিটি দেওয়া, স্ত্রীকে যততত্র আঘাত করা, চুড়ি পরতে হবে, বাপের বাড়ি যাওয়া যাবে না প্রভৃতি নারীর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফল। একজন নারী অন্য নারীকে ও এভাবে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। নারীর মানসিকতা সুস্থভাবে, সুস্থ বিকাশ ঘটুক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আজ্ঞাবহ না হয়ে যৌক্তিক জীবনে শিরদাঁড়া উঁচু করে বাচুক নারী। বিশ্বের বুকে গড়ে তুলুক আপন জগৎ।