জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী: যে নাম ছড়িয়ে গেল সবখানে
আড়াই দশক আগের ঘটনা৷ রান্নাঘরে দুর্ঘটনায় শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে যায় জান্নাতুল ফেরদৌস আইভীর৷ তারপর থেকে পোড়া ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকার দীর্ঘ সংগ্রাম তার৷
আইভী শুধু নিজের লড়াইয়েই ব্যস্ত থাকেননি৷ একটা সময় বাংলাদেশের ‘দগ্ধ প্রতিবন্ধী’ নারীদের অধিকারের পক্ষেও সোচ্চার হন, কাজ শুরু করেন তৃণমূলে, প্রতিষ্ঠা করেন বেসরকারি সাহায্য সংস্থা-এনজিও ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’৷ সাহিত্য, চলচ্চিত্রের মতো সৃজনশীল মাধ্যমেও সক্রিয় হন তিনি৷ লেখক আর নির্মাতা হিসেবেও জান্নাতুল তুলে ধরেন সমাজের সেই পিছিয়ে পড়া নারীদের কথা, যারা প্রতিবন্ধিতা নিয়েই লড়ে যাচ্ছেন অবিরত৷
সমাজ আর রাষ্ট্রের অবহেলা-অনাদরে পিছিয়ে থাকা দগ্ধ নারীদের নিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস আইভীর কাজ জানতে পেরেছে বিবিসি৷ তাই চলতি বছর তাদের বিশ্বের অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় বাংলাদেশ থেকে স্থান পেয়েছেন তিনি৷
সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, মেয়েদের ব্যালন ডি’অর-জয়ী আইতানো বনমাতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিশেষজ্ঞ টিমনিত জিবরু ও হলিউড অভিনেত্রী আমেরিকা ফেরেইরার মতো ব্যক্তিত্বরা যে তালিকায় আছেন, সেখানে স্থান পাওয়ার বিষয়টি তার কাজের বড় স্বীকৃতি বলে মনে করছেন জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বিবিসির তালিকায় নাম প্রকাশের বিষয়টি পরিচিত একজন আমাকে ফোন করে জানান৷ তারপর থেকে অনেকেই যোগাযোগ করছেন, আমার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইছেন৷ আমি বিবিসিতে কোনো আবেদন করিনি, তারাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে৷ তারা আমার সাক্ষাৎকারও নেয়নি৷ তবু দগ্ধ নারীদের অধিকার নিয়ে আমার কাজ সম্পর্কে যেভাবে লিখেছে, তাতে আমিও অবাক হয়েছি৷ আমাকে নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছে৷ আমার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে কী তুলে ধরতে চাই, সেসব নিয়ে যেভাবে লিখেছে, তা আমাকে বিস্মিত করেছে৷’’
তিনি আরো বলছেন, ‘‘আমরা এখনো ছোট পরিসরে কাজ করছি৷ তবু বিবিসির তালিকায় স্থান পাওয়াটা প্রত্যাশার চাইতেও বেশি কিছু৷’’
আগুনের দিন পেরিয়ে…
শরীরজুড়ে যন্ত্রণা৷ চেহারায় আগুনের ক্ষত৷ সুস্থ হতে, ত্বকের ক্ষত সারাতে অর্ধশত বারের বেশি চিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির নীচে যেতে হয়েছে জান্নাতুল ফেরদৌস আইভীকে৷ ১৯৯৭ সালের সেই অগ্নি দুর্ঘটনার পর থেকে তাকে নিয়ে লড়ে গেছে স্বজনরা৷ অগাধে অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে তার চিকিৎসার জন্য৷ তবু তারা থেমে যাননি৷ পরিবারের এই সমর্থন নিয়ে এখনো আপ্লুত আইভী৷ মা-বাবা-ভাই-বোনকে পাশে পেয়েছেন সবসময়৷ তবে দূরবর্তী একজন আত্মীয়ের একটি কটূকথা এখনো পীড়া দেয় তাকে৷ যিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে দেখতে এসে বলেছিলেন, ‘‘ও তো পরিবারের বোঝা হয়ে থাকবে৷ তাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলাই উত্তম৷’’
এ কথায় দমে যাননি আইভীর বাবা শরীফ জাফর আহমেদ সিদ্দিকী এবং মা মরিয়ম সিদ্দিকী৷ তাদের অনুপ্রেরণায় অফুরান প্রাণশক্তি নিয়ে জীবনের পথে থেকেছেন তিনি৷ বাধা পেরিয়ে আইভী নিয়েছেন উচ্চশিক্ষা৷ উন্নয়নকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ ‘দগ্ধ নারী প্রতিবন্ধীদের’ নিয়ে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাঙ্খা নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস, নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র৷
পোড়া ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা নারীদের চলার পথ মসৃণ নয়- সেটা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই পদে পদে জেনেছেন আইভী৷ নিজের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ও তৃণমূল গবেষণায় জেনেছেন শুধু প্রতিবন্ধী বলে কম দেওয়া হয় বেতন৷ আরো নানা বাধা থাকে তাদের জীবনে৷ এসব দূর করতেই আইভী ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অলাভজনক সংস্থা- ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’৷ দগ্ধ ‘প্রতিবন্ধীরা’ যাতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়, তা নিয়ে কাজ করছেন তারা৷ কারণ, বর্তমান আইনে এ ধরনের মানুষদের কথা ভাবা হয়নি৷ তাই তারা বঞ্চনার মধ্যেই থেকে যান বলে মনে করেন ভয়েস অ্যান্ড ভিউজের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী৷
এর পাশাপাশি পোড়ার ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষদের যে মানসিক যন্ত্রণা, তা সারাতেও উদ্যোগ নিতে চান তিনি৷ ডয়চে ভেলেকে আইভী জানালেন, তিনি যখন দুর্ঘটনায় পড়েন, তখন দেশে পোড়ার ক্ষত চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থাই ছিল না৷ এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷ তবে দগ্ধ মানুষরা মানসিক যে আঘাত পান, সেটা সারাতে সেভাবে কাজ হচ্ছে না এখনো৷ তাদের সংস্থা থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে- এ প্রত্যাশার কথা জানালেন তিনি৷
আইভী স্বপ্ন দেখেন, এদেশে একদিন প্রতিবন্ধীরা পরিবহণে কটূ কথা শুনবে না৷ ভবনের নকশা অনুমোদনেও প্রতিবন্ধী মানুষটির কথা মাথায় রাখা হবে৷ রাষ্ট্র যাতে এসব বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করে- নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে এসব নিয়ে সহায়তামূলক কাজও করবেন বলে জানালেন তিনি৷
অনন্যা/এআই