৮ মার্চ কি কেবলই প্রতিপাদ্যে আটকে থাকা একটি দিন
৮ মার্চ বিশ্ব নারীদিবস। মূলত এটি আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবস হিসেবেই পরিগণিত। বিশেষ এই দিনটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। নারীর মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা কমানো এবং কাজের জন্য মানবিক পরিবেশ, এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই ১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিল সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেইসব প্রতিবাদী নারীদের উপর চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে বিশ্বের ১৭টি দেশ থেকে ১শ’ জন নারী প্রতিনিধি যোগ দেয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল থেকেই ‘৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস’ পালিত হয়ে আসছে। সুদীর্ঘ ৪৯ বছরেও নারীর প্রতি যে বৈষম্যতা যে সহিংসতা বিরাজমান তার প্রতিকার তো নয়ই বরং সুদূর ভবিষ্যতেও একটি সুস্থ-সুন্দর ও আধুনিক সম্ভাবনাময় পরিবেশ আমরা নারীদের জন্য উন্মুক্ত রেখে যেতে পারব কিনা তা আজ প্রশ্নাতীত। বাংলাদেশে নারী জাগরণ বা নারীমুক্তির এক অদম্য অলোকবর্তিকা বেগম রোকেয়া। তিনি তাঁর দূরদর্শী চিন্তাভাবনা ও উদার মন-মানসিকতার আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন বাঙালি নারীদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, গোঁড়া পর্দাপ্রথা, আদিম-কুসংস্কার এসবের এক কঠিন দেয়াল ভেঙে। তার জন্য করেছেন লড়াই। কিন্তু উশৃঙ্খলতা-উগ্রবাদিতা এবং অযৌক্তিক যুক্তি তিনি উপস্থাপন করেননি। নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো তুলনা খোঁজেননি, উনি চেয়েছেন কেবল নারীদের মানবিক অধিকার। সফলতা পেয়েছিলেন বটে কিন্তু সেই অস্তিত্বের লড়াইয়ে নারী আজ নাস্তানাবুদ।
নারী তো মানবভ্রমণ হয়েই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় তবে কেন এই ব্যবচ্ছেদ? কেন প্রতিকূলতার সাথে অহর্নিশ লড়াই- নিজেকে আলাদা করে চেনাবার ? নারী যদি ঘরে সম্মান না পায় তাহলে বাইরে সে সম্মানিত হবে, এটা আশা করা বোকামি। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে দেখবেন, পারিবারিক কোনো বৈঠকে নারীরা কিছু বলতে গেলেই মান্ধাতা আমলের মতোই বলা হয়, তুমি চুপ করো, তুমি এসবের মধ্যে কথা বলো না বা তুমি এসবের কি বোঝো বলে থামিয়ে দেয়া হয় ।
শ্রমজীবী নারীদের কথা যদি বলি। একই কাজ একই পরিশ্রম অথচ দিনশেষে দেখা যায় একজন নারীশ্রমিক পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পাচ্ছে। কেন? মেয়ে বলে? কথিত অবলা বলে?
বর্তমানে আমাদের দেশে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা লেখাপড়ায় কোনো অংশে পিছিয়ে নেই; কিন্তু চাকরির বাজারে এখনো মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা এগিয়ে। ভিন্নচিত্রও দেখা যায়। যেমন কোনো মেয়ে যদি উচ্চপদে থাকে বা তার কর্মদক্ষতার গুণে পদোন্নতি হয় তাহলে কানপাতা দায়, আরো ঐ মেয়ের তো বস-এর সাথে চরম খাতির। নাহলে কি আর এত অল্প দিনেই প্রমোশন হয় ? আবার ধরুন, নাটক-সিনেমা। এটাও তো কাজ। খেয়াল করলে দেখবেন, অধিকাংশ গল্প পুরুষপ্রধান চরিত্র নিয়ে এমনকি পর্দায় যখন শিল্পীদের পরিচিতি দেখানো হয় সেখানেও পুরুষ শিল্পীর নামের প্রাধান্য সবার উপরে। কেন? তাহলে একজন ইটভাটার অশিক্ষিত মালিক আর একজন শিক্ষিত পরিচালক এবং প্রযোজক-পার্থক্য আছে কি ?
আসলে নারীর অধিকার পুরুষ থেকে আলাদা নয়, এ অধিকার মানবিক। যেমন ধরুন, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। সবচেয়ে বাজে এবং বিপজ্জনক জায়গায় নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা করে ৬টা আসন বরাদ্দ করা হয়। সময়ের সাথে সাথে সামাজিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । পাবলিক বাসে এখন নারী-পুরুষ প্রায় সমান সমান। অথচ একটু ভিড় হলেই পুরুষ যাত্রীরা বলেন, ‘এই গাড়ি থামিও না মহিলা উঠানোর জায়গা নাই কিংবা ড্রাইভার বলে এই মহিলা তুলিস না সীট নাই।’ পুরুষের দৃষ্টিবোধের কি পতন ভাবুন একবার। তাহলে ওই সমস্ত কর্মজীবী নারী বা তরুণীরা কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা? এছাড়া ভিড় বাসে নারীদের ফিজিক্যাল এবিউস (শারীরিক নির্যাতন) হবার ঘটনা তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বর্তমান দৃশ্যপট তো আরো ভয়ঙ্কর, কি নির্মমভাবে বাসে নারীদের একা পেয়ে ধর্ষণ করে হত্যা করা হচ্ছে। সেখানে অধিকার তো দূরের কথা, প্রাণে বাঁচাটাই যেন দায়। আমাদের দেশের স্বনামধন্য একজন অভিনেত্রী এবং ব্যবসায়ী তাঁর সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, আমার নিজের গাড়ি না থাকলে আমার মেয়েকে এই শহরে চাকরি করতে দিতাম না। প্রতিদিন এই শহরে হাজার হাজার তরুণী প্রবেশ করছে, লড়াই করছে জীবনযুদ্ধে, ক’জনার ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, যা তাকে রেহাই দিবে হায়েনার থাবা থেকে? আসলে এভাবে পালিয়ে বাঁচা যায় না। বাঁচতে হলে আগে বদলাতে হবে পুরুষের কামার্ত দৃষ্টিভঙ্গি, বদলাতে হবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি । যেন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা, এক বর্বরতার যুগে বাস করছি। রোজ কাগজে টিভিতে একই খবর ধর্ষণ-হত্যা-গুম। শিশু-তরুণী-বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না এই ধর্ষণ নামক ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি থেকে। যে সমাজে যে দেশে একটি কন্যা শিশু বা কিশোরী তার মৌলিক এবং সামাজিক নিরাপত্তাটুকু নিয়ে বেড়ে উঠতে পারছে না, সেখানে নারীর অধিকার দাবি কতটা ফলপ্রসু হবে তা আসলেই ভাবনার বিষয়।
তাহলে কেন ৮ মার্চকে ঘিরে এত উল্লাস এত উদ্দীপনা সারা বিশ্বজুড়ে? বেগুনি রঙের শাড়ি চুরি পরে সেজেগুজে রাস্তায় বের হলেই কি মিটে যাবে সমস্ত দাবি-দাওয়া? নাকি তার পরিপ্রেক্ষিতে লাভবান হবে পুঁজিবাদীরা? পুঁজিবাদদের প্রধান নিশানা বিজ্ঞাপন। যে-কোনো দিবসকেই অনাহুত উদযাপনের পেছনে রয়েছে তাদের বিশাল ব্যবসায়িক চিন্তাধারা। নারীদিবসও এর ব্যতিক্রম নয় বরং এক ধরনের বিজ্ঞাপনে রূপ নিয়েছে। সারা পৃথিবীর কর্পোরেট লোকেরা এই দিনটিকে ঘিরে আয় করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। তাতে কি সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী নারীদের জীবনধারা বদলে যাচ্ছে? গ্লোবালাইজেশনের এই আধুনিক যুগেও শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল নারীকেই রাস্তায় নেমে নিজেদের অধিকার-নিরাপত্তা নিয়ে লড়াই করাটা লজ্জাজনক।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নারী অধিকার রক্ষায় গৃহীত হয়েছে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ সনদ স্বাক্ষরও করে। এটি আন্তর্জাতিক দলিল ও প্রতিশ্রুতি। কিন্তু আমাদের দেশে এর বাস্তবায়ন এখনো সুদূর পরাহত।
বলতে দ্বিধা নাই একা বাড়ি, একা ঘর, একা রাস্তা, একা বাস-ট্রাম অফিস-আদালত, এমনকি এত বড়ো পৃথিবীর কোথাও একলা নারী নিরাপদ নয়। ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ কোথায় তবে সে মুক্তি আকাশ? নারীর প্রতি এই অমানবিক প্রবৃত্তি এবং নির্মমতার শেষ কোথায়? সচেতনতা বাড়াতে হবে পুরুষের, নারীর নয়। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র কোথায় নেই নারীর নিরন্তর সংগ্রাম? পুরুষ যদি নারীকে তাদের মতোই মানবমনে করে, সম্মানটুকু দিতে পারে, তাহলে এসব দিবসের আদৌ কোনো প্রয়োজন পরে কি ? তাই ৮ মার্চ এই দিনটিকে এক বিশেষ প্রতিপাদ্যে আটকে না রাখি, বরং প্রতিটা দিনই হোক নারীর দিন; এমন স্বপ্ন বুনি।