সারাহ বেঁচে আছেন চার জনের শরীরে
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ,
‘সুখ-সুখ’ করি কেঁদো না আর;
কামিনী রায়ের লেখা এই লাইনগুলোর যেন পূর্ণতা দিয়েছেন সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য। মাত্র বিশ বছর বয়সে জীবনপথের যাত্রা থেমে গেছে তার। কিন্তু মৃত্যু যেন তাকে এনে দিয়েছে নতুন পরিচয়। সারার যেন নতুন জন্ম হয়েছে। সারাহর মৃত্যুর পর তার দুটি কিডনি ও দু’টি কর্ণিয়া নিয়ে সুস্থ আছে চারজন মানুষ। তাদের চোখে বিশ্ব দেখছেন সারা। দেখছেন কিভাবে মৃত্যুর পরও বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়ে।
সারাহ ইসলাম মৃত্যুর সময় তাঁর দুইটি কিডনিই দান করে গেছেন। দুইটি কর্নিয়াও। তাঁর দুইটি কিডনি দুজনের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। দুজনই নারী। এরই মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসাজগতে প্রথমবারের মতো একটি ঘটনা ঘটে গেল। দেশে এ প্রথম কোনো মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি প্রতিস্থাপন করা হলো অন্য ব্যক্তির দেহে। ভারতে সাত-আট বছর আগ থেকেই এ কাজ শুরু হয়। আমাদের দেশে কয়েকবার চেষ্টা করেও হয়ে ওঠেনি। এবার সেটি সম্ভব হলো।
আমাদের দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে সারাহর নাম উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে। সারার মত সাহসী ও বিচক্ষণ এক মেয়ের বোধহয় এমনটাই প্রাপ্য ছিলো।জন্মের শুরুতেই সারাহ জীবনসঙ্কটে পড়েন। মাত্র ১০ মাস বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধি টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস নামের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন তিনি। দেহকে কুরে কুরে শেষ করে দেওয়া এই রোগ নিয়েই পার করেছেন ১৯ বছর।
তীব্র মানসিক শক্তি নিয়েই তিনি জীবনের ১৯ বছর পাড়ি দিয়েছেন। শৈশবে এই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সারাকে। এমনকি বন্ধুরা কেউ তার কাছে আসতে চাইত না, পাশে বসতো না। এমন পরিস্থিতিতে যে কারোই ঝরে পরার আশঙ্কা থাকে তীব্র। তবে সারাহ দমে যাওয়ার পাত্রী নন। তার জন্মই তো হয়েছে আলোর মশাল জ্বালাতে। তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন এতো সহজে তাকে থেমে গেলে চলবে না। তাইতো শত প্রতিকূলতাকে জয় করে তিনি এগিয়েছেন। এক দুঃসহ পথ পাড়ি দিয়ে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন তার প্রিয় বিষয় ফাইন আর্টস নিয়ে।
সম্প্রতি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শৈশব থেকে মেয়ের দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে মেয়ের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে মা শিক্ষিকা শবনম সুলতানা বলেন, শৈশব থেকেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই ভয় পেত। কেউ তার পাশে বসতে চাইত না। এ জন্য সে অনেক কষ্ট পেত, মাঝে মাঝে কাঁদতো। সারাহ জানতেন তার দুরারোগ্য ব্যাধির কথা, এও জানতেন, তিনি বাঁচবেন না। একদিন মাকে বলে গিয়েছিলেন প্রয়োজন হলে আমার ব্রেনও তুমি দান করে দিও আমার মৃত্যুর পর। সবকিছুই তুমি গবেষণার জন্য দিয়ে দিতে পার, মা।
মেয়ের শেষ ইচ্ছে মা পূরণ করেছেন। গত কয়েকদিন আগে তাকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়। বুধবার ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণার পর মেয়ের ইচ্ছের সম্মান জানাতে মা শবনম সারাহর অঙ্গ দানে সম্মতি দেন। সারাহর দুটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দু’জনের দেহে। কর্নিয়া দুটিও প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দু’জনের চোখে। গত বুধবার বিএসএমএমইউতে একটি কিডনি ও কিডনি ফাইন্ডেশনে অন্য কিডনি দুই নারীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। পরের দিন অর্থাৎ গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁর দুটি কর্নিয়া দুই পুরুষের চোখে লাগানো হয়। একটি বিএসএমএমইউতে এবং অন্যটি সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে। তারা প্রত্যেকেই এখনও সুস্থ আছেন।
সারাহ চিরকালের মতো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। কিন্তু খুলে দিয়ে গেছেন এক বদ্ধ দরজা। তার দেখানো পথ ধরে দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে এখন এগিয়ে যেতে পারবে বহুদূর। সারাহ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেও সারাহর মায়া পৃথিবী ত্যাগ করেনি। চারজন মানুষের শরীরে বেঁচে আছেন তিনি। তাদের চোখে দেখছেন বিশ্ব, শুনছেন তার নামের জয়োধ্বনি।