করোনায় নারীর কপালে বাড়ছে চিন্তার ভাঁজ
শিল্প-কারখানার চাকা ঘোরাতে কিংবা এর সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের জন্য সরকার ঘোষিত সাড়ে ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ কিছুটা হলেও সাহস যোগাচ্ছে এ কথা বলতেই হবে। আর সেই তালিকায় হয়ত দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী কিছুটা সুবিধা পাবেনও এই দুর্দিনে। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখছি; কাজের বুয়া বলে পরিচিত যে নারী দুইবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য যুদ্ধ করে তার কি হবে? তার মালিক (চাকরি অর্থে) কি সত্যিই তাকে ছুটিতে পাঠানোর আগে কিছু টাকা ধরে দিয়েছেন হাতে। যে মেয়েটা খাবার হোটেলের রান্নাঘরে বসে বসে দিনরাত মসলার যোগান দেন তিনিও কি পেয়েছেন বেঁচে থাকার নির্ভরতা?
ফেরিওয়ালা যে নারী সামান্য পয়সা আয় করে ফুটপাতে অপেক্ষায় থাকা সন্তানের মুখে একবেলা খাবার তুলে দিয়ে পরম তৃপ্তি নিয়ে দেখেন সেই দৃশ্য, সেই নারী কি ভালো আছে কোয়ারেন্টাইনের এই সময়ে। এইসব মানুষগুলো সবসময় চোখের সামনেই থেকেছে তবুও তাদের কষ্ট কতটুকু বুঝেছে এই সমাজ? আর চরম মহামারির দিনে তারা যে কেমন থাকবেন তা সহজেই অনুমান করা যায়!
যুগে যুগে মহামারির সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছিন্নমূল নারী ও শিশুরা। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের মহামারিও তাদের জন্য মরণ ডেকে এনেছে। এই মরণ থেকে বাঁচতে যখন সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, তখন অসহায় নারী ও শিশুদেরই বেশি পাওয়া যাচ্ছে ত্রাণের লাইনে। সমস্যা এমন যে, জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ! যেখানে যাক না কেন মরণ ধাওয়া করে ফিরছে তাদের।
উভয় সংকটে ভ্রাম্যমাণ নারী শ্রমিকরা
সারা পৃথিবীই কমবেশি লক ডাউনের মধ্যে আছে। এ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু কাজ কর্ম থাকলেও পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেছে অনানুষ্ঠানিক খাত। কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, হকার, ভাঙাড়ি সংগ্রহকারী, পরিবহন শ্রমিক, খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে আসা নারী ও শিশুদের জন্য কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। যেখানে সচ্ছল মানুষজন হয় বাসা থেকে কাজ করছেন। বই পড়ে, ব্যায়াম করে অথবা মুভি দেখে সময় পার করছেন, সেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার। আবার ত্রাণের জন্য বাইরে গেলেও নেমে আসছে নানামুখী নির্যাতন।
শ্লীলতাহানির ঝুঁকি বাড়ছে ছিন্নমূল নারী ও তরুণীদের
গত ৫ এপ্রিল দৈনিক ইত্তেফাকের ওয়েব পোর্টালে একটি নিউজ ছিলো, ‘ত্রাণ নিতে গিয়ে ১০ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার’। এ কথা বলতে বাধা নেই যে, হাজার বছর ধরে দুর্ভিক্ষের সময়ে নারীদের উপর বর্ষিত হয়েছে একধরনের পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি। তারা ক্ষুধার্ত নারী ও তরুণীদের নিয়ে মেতে উঠেছে আদিমতায়। সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে আসা নারী ও তরুণীদেরও একই অবস্থার মুখে পড়তে দেখেছি আমরা। সংকট বাড়লে খেটে খাওয়া দিনমজুর নারীদের পড়তে হবে নানান শ্লীলতাহানির মুখে। মৃত্যুও ডেকে আনবে নিরবেই।
করোনায় বেড়েছে গৃহবধূদের কাজ
এমনিতেই সংসার যত ছোটই হোক একজন নারীই বলতে পারবেন এই সংসার গোছাতে দিনরাত তাকে কত পরিশ্রম করতে হয়। এরমধ্যেই করোনার উৎপাতে কাজ বেড়েছে কয়েকগুণ। রান্নাবাড়া, ঘর গোছানোর সঙ্গে যোগ হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তাবিধান করা। বাজার ফেরত স্বামীর জন্য পৌঁছে দাও ব্লিচিং পাউডার পানি। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘর মোছ। সন্তানদের হাত ধুঁয়ে দাও কিছুক্ষণ পরপর। তার উপর কাজের মেয়েদের যে সার্ভিসটুকু তাকে স্বস্তি এনে দিতে তাও বন্ধ! বন্ধ ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের দুনিয়া দেখার সামান্যতম ফুঁসরতও তার হাতে আর অবশিষ্ঠ নেই।
বিপাকে চাকরিজীবী নারীরাও
ভোগান্তির পাল্লায় বাদ যাচ্ছেন না চাকরিজীবী নারীরাও। অনলাইনের যুগে অফিসের কাজ যেমন সামলাতে হচ্ছে তেমনি ঘরকন্নাও দেখতে হচ্ছে তাকেই। দীর্ঘসময় বাসায় থাকায় স্বামী-সন্তানদের বায়না বেড়েছে বহুগুণ। গত জানুয়ারি মাসে গ্যালাপের একটি জরিপ বলছে, সন্তানদের যত্নআত্তি ও দেখভালের ক্ষেত্রে প্রতিদিন পুরুষদের তুলনায় নারীদের ৭ গুণেরও বেশি সময় দিতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীদের ওপর সেই চাপ আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
করোনা চিকিৎসার ঝুঁকিতেও সামনের সারিতে নারী
করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা; বিশেষ করে চিকিৎসক ও নার্সরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পুরো পৃথিবীতে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কাজে নিয়োজিত লোকবলের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী।
চীনের হুবেই প্রদেশে (যেখান থেকে কোভিড-১৯-এর উদ্ভব বলে ধারণা করা হচ্ছে) স্বাস্থ্যকর্মীদের ৯০ শতাংশই নারী। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় হিসাব অনুযায়ী, সে দেশে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নারী ৭৬ শতাংশ। আমাদের দেশেও এই সংখ্যা কম হবে না। ফলে যে রোগের এখনো কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, সেই রোগের ক্ষেত্রে বিশাল ঝুঁকির মুখে রয়েছে এই খাতের নারীরা।
বর্তমানের এই অবস্থা শুধু বাংলাদেশেই নয়। পুরো বিশ্বের চিত্রই বলতে গেলে এক। নারী একাই ঘরের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা, খাদ্য, পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলো দেখছেন। করোনাভাইরাসের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। এই অবস্থায় নারীদের প্রতি একটু সুবিচার করতেই পারেন সংসারে থাকা পুরুষ মানুষগুলো। আর সরকারের উচিত ভ্রাম্যমাণ নারী ও তরুণীদের খাবার ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা। নাহলে পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপের দিকেই যেতে থাকবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।