Skip to content

১১ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২৮শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘বেগম’ পত্রিকার বেগমের গল্প

তখন ভারতবর্ষের আবহাওয়া উত্তাল। দুইটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম তখন হাজারো মানুষের বুকে যেমন স্বপ্ন গড়ে তুলতে শুরু করেছে তেমনই ভারতবর্ষে উত্তেজনাও বাড়িয়েছে। দেশভাগের কিছুদিন আগেই কলকাতায় নারীদের জন্য একটি সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। সওগাত পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন এর প্রতিষ্ঠাতা। যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে নারীদের অন্দরমহলের বাইরেই বিচরণ করা কঠিন। সেখানে সচিত্র নারী বিষয়ক পত্রিকা তা হোক সাপ্তাহিক, বেশ কঠিন একটি কাজ। এই পত্রিকাটির নাম, "বেগম পত্রিকা"। মূলত মুসলিম নারী মনীষা ও লেখকদের উৎসাহী করতেই এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠা। আর এই পত্রিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা যথেষ্ট কঠিন। সেই কাজ বহুবছর নিজ হাতেই ধরে রেখেছিলেন নূরজাহান বেগম। নূরজাহান বেগম বাঙালী নারী সাংবাদিকতার অন্যতম অগ্রদূত। তাহলে চলুন জেনে নেই বেগম পত্রিকার নূরী বেগমের গল্প।

নূরহাজান বেগমের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন। কর্মসূত্রে পিতা নাসিরউদ্দিন ব্যস্ত থাকতেন কলকাতায়। ১৯২৯ সালে নূরজাহান বেগমকেও মা ফাতেমা বেগম এবং মামা ইয়াকুব আলী শেখের সাথে কলকাতায় চলে যেতে হয়। সওগাত পত্রিকার সদর দপ্তর ১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিটের দোতলা পরিবারে শুরু হয় বসবাস। সম্ভবত এই পরিবেশ থেকেই নূরজাহান বেগম সাংবাদিকতার কিংবা লেখালেখির আগ্রহ পান। সওগাত পত্রিকা অফিসে সাহিত্য আড্ডা হতো নিয়মিত। সেখানে কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, ইবরাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন এবং হবীবুল্লাহ বাহারের মতো সাহিত্যিকদের আনাগোনা হতো। সেখানে নূরী ছিলেন একজন নিয়মিত শ্রোতা।

 

একদিন নাসিরউদ্দিন প্রতিষ্ঠা করেন 'বেগম পত্রিকা।" বেগম সুফিয়া কামালকে এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক নিয়োগ দেয়া হয়। তার সহযোগী ছিলেন নূরজাহান বেগম। নাসিরউদ্দিন এবং তার কন্যা সম্ভবত একে অপরের সাথে এসকল বিষয় নিয়ে প্রচুর কথা বলতেন। পিতা এবং কন্যা নারীর অগ্রগতি এবং অধিকার নিয়ে যা ভাবতেন তার প্রতিফলন এই বেগম পত্রিকায় পাওয়া যেতো। একদম শুরু থেকেই নারীর গৃহকর্ম এবং নানাবিধ সমস্যার কথা প্রকাশিত হতো এই পত্রিকায়। খুব দ্রুতই বেগম পত্রিকা নারীদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা এবং বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। বিশেষত মুসলিম নারী লেখক তৈরিতেও এই পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষত পঞ্চাশের দশকেই শিক্ষিত নারী লেখকরা বেগম পত্রিকাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। 

 

এমন একটি পত্রিকার সম্পাদনার কাজ খুব সহজ না। বেশ কিছুদিন পর কবি সুফিয়া কামাল নিজের ব্যস্ততার জন্যে বেগম পত্রিকা সম্পাদনার কাজ ছেড়ে দেন। ঠিক তখন হাল ধরেন নূরজাহান বেগম। তার হাতেই আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে বেগম পত্রিকা। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে বেগম পত্রিকার অফিস স্থানান্তরিত হয় ঢাকার পাটুয়াটুলিতে। দীর্ঘ ৭২ বছর ধরেই বেগম পত্রিকার অফিস সেখানে। সেই পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এখনো। ১৯৫৪ সালেই নাসিরউদ্দিন প্রতিষ্ঠা করেন বেগম ক্লাব। সেখানে সেক্রেটারি পদে নূরজাহান বেগম। বিভিন্ন নারী লেখকদের সেখানে আহ্বান করে আড্ডা বা আলোচনার ব্যবস্থা করা হতো।

 

বেগম সুফিয়া কামাল দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার পর নূরজাহান বেগম নেমে পড়েন কাজে। বছরে ৪৮ টি সংখ্যা প্রকাশ চাট্টিখানি কথা না। তবু  সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন নূরজাহান বেগম। এর জন্যে প্রচারণা করতে হয়েছে তাকে। প্রথমত, নারীদের পক্ষে অফিসে এসে লেখা দেয়া সম্ভব ছিলোনা। কিন্তু প্রচুর চিঠি ডাকে আসতে শুরু করতো। সেই লেখাগুলো পড়া এবং গুছিয়ে জবাব দেয়ার মতো কাজও তিনি করেছেন। মূলত উৎসাহ সৃষ্টি এবং নারীদের লেখালেখি কিংবা সাংবাদিকতার অঙ্গনে নিয়ে আসার মতো পরিশ্রম সেই সময়ে ছিলো বিরাট ক্লান্তিকর। 

 

হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের নারীদের কাছেই বেগম পত্রিকা সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে একটি পত্রিকা চালানো সহজ না। বাড়ি গিয়ে গিয়েও নূরজাহান বেগমকে লেখা সংগ্রহ করতে হয়েছে। নূরজাহান বেগম এক সময় বলেছিলেন, "মেয়েরা এখন হরহামেশা বাইরে পড়তে যাচ্ছে। উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরছে। তারপরও আমার মনে হয় নারীকে আরও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। তাহলে সামাজিক উন্নয়ন দ্রুত ঘটবে। যোগ্যতার সুবিচার করতে হবে তাদের।"

 

এভাবেই নারী সাংবাদিকতা এবং লেখালেখির জগতে বাঙালী নারীদের পরিচয় করানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন নূরজাহান বেগম। ১৯৫২ সালের উত্তাল সময়েই তিনি সাংবাদিক ও শিশু সংগঠক রোকনুজ্জামান খান কিংবা দাদা ভাইকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরেও তিনি সাংবাদিকতা নিয়ে লেগে রইলেন। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজীবন কাজ করে গেছেন তিনি। ২০১৬ সালেই নূরজাহান বেগম মৃত্যুবরণ করেন। রেখে যান বেগম পত্রিকার অফিস। কলকাতা থেকে নিয়ে আসা অফিসের চেয়ার আর বেগম পত্রিকার অফিস সেই পুরোনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। এখানে এক অন্যতম প্রধান নূরজাহান বেগম।

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ