সমাজের তাড়নায় পুরুষবেশী ইশতিয়াক
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সিঙ্গেল মায়েদের প্রায়ই শুনতে হয় নানা কটু কথা। নুসরাত জাহান হোক কিংবা অপু বিশ্বাস একা মায়ের সন্তান লালনের সংগ্রামটি সাধারণ মানুষের চোখে পড়েনা। পড়বেই বা কি করে বেশির ভাগ মানুষ তো তাদের নিয়ে কুৎসা রটনাতেই ব্যস্ত। আমাদের উপমহাদেশে এই প্রবণতা অনেক বেশি। একবার ভাবুন একজন সেলিব্রেটিকেই যদি সিঙ্গেল মাদার হতে হলে এতো কথা শুনতে হয় তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কেমন হয়!
এক্ষেত্রে সাধারণ একজন সিঙ্গেল মাদারের পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ায় আরো কঠিন। আজ এমনি একজন সিঙ্গেল মায়ের গল্প শুনবো একাকী সন্তান নিয়ে সমাজের ভয়ে যাকে নিতে হয়েছিলো পুরুষের বেশ।
নাম ফারহিন ইশতিয়াক। পাকিস্তানের করাচিতে পরিবারের সাথে বাস করতেন তিনি। ২০১০ সালে প্রেমের কারণে পরিবারের অমতে গিয়ে বিয়ে করেন তরুণকে। পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়ায় পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয় তার। বিয়ের কিছুদিন পরেই ইশতিয়াক গর্ভধারণ করেন। গর্ভকালীন অবস্থায় তার স্বামী তাকে রেখে পালিয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই জন্ম দেন একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের। হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে যখন তিনি সন্তানের জন্ম দিচ্ছিলেন তখন তার পাশে কেউই ছিলোনা। তখন তিনি ডাক্তারকে বলেছিলেন, “ যদি আমার কিছু হয় আমার সন্তানকে আমার বাবা- মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েন।” সুস্থভাবেই তিনি সন্তানের জন্ম দেন। মেয়ের নাম রাখেন রিদা জাহরা।
এরপর থেকে শুরু হয় ইশতিয়াকের আসল সংগ্রাম। এরপর থেকেই কেবল মেয়েকে একটি সুন্দর জীবন দেয়াই তার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। করাচি থেকে ৮৫০ কিলোমিটার দূরে পাঞ্জাবে ইশতিয়াকের এক বন্ধু ছিল। প্রথমে তিনি তার সন্তানকে ওই বন্ধুর কাছে রেখে আসেন। কারণ সন্তান সামলানো ও অর্থ উপার্জন দুটোই একসাথে করা সম্ভব ছিলোনা তার পক্ষে। তিনি এসময় ওয়েটারের কাজ নেন একটি হোটেলে। প্রায় দেড় বছর তার ওই বন্ধুই রিদার দেখাশোনা ও লালনপালন করেন। এরপর তার বন্ধু সমস্যার কথা জানায় ইশতিয়াককে। সন্তানকে নিয়ে এবার তিনি যান বাবা- মায়ের বাড়িতে তাকে একটু দেখাশোনা করার জন্য।
আবার অনেকেই তাকে লাহোরে অবস্থিত একটি গার্লস হোস্টেলের কথা বলল যেখানে তিনি রিদাকে রেখে বাইরে কাজ করতে পারবেন। কিন্তু পাকিস্তানের মতো জায়গায় নারীর একাকী বসবাস খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আর ইশতিয়াক চাচ্ছিলেন মেয়ে নিয়ে একসাথে থাকতে। কিন্তু একজন একা মা হিসেবে এটা প্রায় অসম্ভব ছিল। সমাজের মানুষের নানা কটু কথার শিকার হতে হতো তাকে। আবার একা মা দেখে অনেকের হয়রানির শিকারও হতে হতো তাকে।
প্রাথমিক অবস্থায় লাহোরের ব্যস্ততম বাজার আনারকলি বাজারে হকারির কাজ শুরু করলো ইশতিয়াক। বিভিন্ন নাস্তা জাতীয় খাবার বানিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করতো সে। কিন্তু এ অবস্থায় বারবার সে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে লাগলো। পাকিস্তানে একজন নারীর হয়রানির শিকারের ঘটনা খুবই সাধারণ ছিল। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে কর্মক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময়ে একাকী নারীকে হতে হয় যৌন হয়রানির শিকার। এসব ভেবে তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো।
নারীর পোশাক বাদ দিয়ে চুল ছোট করে কেটে পুরুষের পোশাক পরে নেমে পড়লেন কাজে। হয়ে উঠলেন রিদার বাবা। লাহোরের সেই আনারকলি বাজারেই তিনি শুরু করলেন আবার হকারির কাজ। এবার আর তাকে হয়রানির শিকার হতে হলোনা। এভাবে কিছুদিন কাজ করে বেশ টাকা আয় করলেন তিনি। এবার সেই টাকা দিয়ে দিলেন নিজের একটি দোকান। প্রতিদিনই তিনি পুরুষদের মত পোশাক পরে দোকানে বসেন। সবার সাথে পুরুষ হিসেবেই চলতে থাকলেন ইশতিয়াক। পরিচিতি পেতে থাকলেন রিদার বাবা হিসেবে।
এবার তিনি কাজ ও সন্তানের দেখাশোনা দুটোই একসাথে করতে পারলেন। মেয়েকে স্কুলেও ভর্তি করে দেন তিনি। স্কুল থেকে এসে রিদা তার বাবার সাথেই দোকানে থাকে এবং তার বাবাকে কাজে সাহায্য করে। আবার অবসর সময়ে ইশতিয়াক তার বাইক চালিয়ে উবারের কাজ করেন। মেয়েদের যাতায়াতের কাজ করেন তিনি। এভাবেই বেশ সুখেই চলছে ইশতিয়াক ও রিদার সংসার।
পাকিস্তানের লেখক জাইন উল হাসানের লেখা একটি টুইট থেকে প্রথম ইশতিয়াকের সম্পর্কে জানে পৃথিবীর মানুষ। তখন তার বয়স ছিল ৪১ বছর বয়স। পুরুষবেশেই তিনি মেয়েকে নিয়ে জীবনযাপন করছে এখন।
ইশতিয়াকের জীবনের ঘটনা আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের ভয়াবহতা তুলে ধরে। তার সংগ্রামী জীবন বর্তমান সমাজে এক অনন্য উদাহরণের সৃষ্টি করেছে।