দূর হোক নারীর প্রতি সহিংসতা
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার হয়ে গেলেও আমাদের সমাজে কন্যা সন্তানেরা যে কোথাও নিরাপদ নয়, সে কথা বারবার উঠে আসছে। প্রত্যেক মানুষ ভয়শূন্য চিত্তে তখনই বেড়ে উঠতে পারে, যখন ভয়হীন পৃথিবী পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। তবে আমাদের সমাজে অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে নারীরা বিশ্বের বুকে নিজেদের অবস্থান করে নিলেও সহিংসতার হাত থেকে অধিকাংশ নারী রক্ষা পাচ্ছে না। এর ফলে প্রকৃত অর্থে যে সংখ্যক নারীদের সামাজকে এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখা অবশ্য বাঞ্ছনীয়, তার অর্ধেকই প্রায় নানাসময়ে বিভিন্ন কারণে ঝরে যাচ্ছে। তবে সবকিছুর মূলে কন্যা শিশুর এই থমকে যাওয়ার নেপথ্য কারণ সহিংসতার ভয়৷
জেন্ডার সমতা না থাকার কারণে কন্যাশিশু জন্মগ্রহণের পর থেকেই পরিবারে, সমাজে সর্বোপরি সর্বস্তরে হেনস্তার শিকার। আর সহিংসতার ভয় নারীদের চলার পথকে রুদ্ধ করছে৷ একজন নারী যা পারে তা পুরুষের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়। তাহলে স্কুল, কলেজে যারা ভর্তি হচ্ছে, তারা কি সবাই পড়াশোনার গণ্ডি আদৌ শেষ করতে পারছে? বা যেই নারীরা উচ্চশিক্ষা অর্জন করছেন তাদের কয়জন কর্মসস্থলে প্রবেশ করছেন? সবকিছুর মূলে রয়েছে নারীর জন্য অসহনীয় পরিবেশ। কন্যশিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহিংসতার ভয়।
ঘর থেকে শুরু করে জনসমাগম সব জায়গায়তেই নারীরা অনিরাপদ। সর্বত্র নারীদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে একশ্রণির হায়েনা। যাদের কামুক লালসায় নারীদের পায়ে শেকল হয়ে দাঁড়ায়। নারী নিজের মেরুদণ্ড যত সোজা করতে চায় ততটাই তারা আঁটকে ধরে জোঁকের মতো। মেয়েদের মধ্যে প্রচুর সম্ভবনা থাকলেও মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে। যতই বর্তমান সময়ে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হোক, আগের তুলনায় কর্মস্থলে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাক তবে সামগ্রিকভাবে নারীদের যতটা অগ্রগতি হওয়া দরকার সে হার বলা চলে নারীরা আজকের যুগে এসেও অনেক পিছিয়ে। এ বিষয়ে প্লান ইন্টারন্যাশনালের জরিপে দেখা মিলছে ভয়াবহ তথ্যের। যার ভিত্তিতে নারীরা আজও পিছিয়ে। মূলত নারীদের চলার পথকে রুদ্ধ করছে।
যে জগতে নারী হবে মুক্ত বিহঙ্গী। ডানা মেলে পাখি। তাই মেয়েরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে চলুক দুর্বার গতিতে। যেই প্রবল গতির সম্মুখে সব অন্যায় নিমেষেই ধসে পড়বে।
বাল্যবিবাহ কারণ সহিংসতার ভয়। মূলত এই চক্রের একটি বড় অংশের ভয়েই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে । প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তারা পিছিয়ে পড়ছে। অল্প বয়সেই ঝরে পড়ছে বাল্যবিবাহের কারণে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপ বলছে, অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৩৫ শতাংশের মতে, যৌন নিপীড়নের ভয় বাল্যবিবাহের অন্যতম মূল কারণ। ২৫ দশমিক ৬ শতাংশের মতে সামাজিক বিভাজনজনিত উদ্বেগের কারণে মা–বাবা মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন।
অংশগ্রহণকারীদের ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ নারীদের দাবি, তাঁরা জনসামগমস্থলে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ৮৬ দশমিক ৮ শতাংশ নারী বলেছেন, তাঁরা সহিংসতার শিকার হয়েছেন পারিবারিক বলয়েই।
পারিবারিক বলয়, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আর জনসমাগমস্থল—এ পাঁচ ক্ষেত্রে জরিপটি করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অশালীন, ক্ষতিকর মন্তব্যের মাধ্যমে নিপীড়নের ঘটনার কথা জানিয়েছেন ৫৭ শতাংশ আর কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন ৫৬ শতাংশ নারী।
সাক্ষাৎকার দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ জানায়, তারা সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে সামাজিকভাবে চিহ্নিত জেন্ডারভিত্তিক পেশায় যেতে বাধাগ্রস্ত হয় এবং ১২ দশমিক ৫ শতাংশ নারীকে মা–বাবার বিধিনিষেধের সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৯০ দশমিক ২ শতাংশ মেয়ে এবং যুব নারী জানিয়েছেন, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতার কারণে বিষণ্ণতার মুখোমুখি হন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৫৬ শতাংশ নারীই নীরব থাকাকেই সমাধান মনে করেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারী অভিভাবকদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মা জানিয়েছেন, সহিংসতার ভয়ে তারা তাদের মেয়েদের স্কুল পিকনিকে অংশ নিতে দেন না, যেখানে বাবাদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ প্রাইভেট টিউশনে যেতে দিতে চান না। আবার ১৭ শতাংশ বাবা- মা মেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে দেন না শুধু সহিংসতার ভয়ে। তবে এই সহিংসতার বিষয়ে আমরা কতটা সচেতন? কয়জন এই বিষয়ে খোলাখোলি তার সন্তানদের সঙ্গে কথা বলছেন? বা কয়টা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা হচ্ছে?
নারীদের পথকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে চাইলে বেড়ে ওঠার পথ পরিষ্কার করতে হবে। কন্যাশিশু যাতে সহিংসতার শিকার না হয় সেজন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। তদুপরি যতদিন মনের বিকারগস্ততা দূরীভূত না হবে ততদিন এই হিংস্রতা থেকে নারীদের রক্ষা পাওয়া ভার। ফলে মেয়েদের সুস্থ, সুন্দর ও ভয়শূন্য পৃথিবী উপহার দিতে হলে পরিবার, সমাজ, প্রশাসনের একযোগে কাজ করতে হবে। আমাদের সমাজের নারীরা এগিয়ে যাক শত প্রতিকূলতাকে পায়ে দলে মুষড়ে। নারীর পায়ে পদদলিত হোক সব অপশাসন-হিংসা-অন্যায়-নিপীড়ন। গড়ে উঠুক নবরূপে পৃথিবী। যেই জগতে নারী হবে মুক্ত বিহঙ্গী। ডানা মেলে পাখি। তাই মেয়েরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে চলুক দুর্বার গতিতে। যেই প্রবল গতির সম্মুখে সব অন্যায় নিমেষেই ধসে পড়বে।