নতুন বছরে নারীর কর্মস্থল হোক নিরাপদ
শুরু হয়েছে নতুন বছর। পুরনো দিনের সব জঞ্জাল ফেলে নতুন বছরের শুভ সূচনা। নতুন বছরে নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছে সবার জীবন। একটা নতুন বছর মানে কেবল একটা নতুন তারিখ, একটা নতুন সাল বা একটা নতুন ক্যালেন্ডার নয়, বরং নতুন করে পথ চলার স্বপ্ন।
ঘরে-বাইরে এখন সমানতালে সামাল দেন নারী। দশভুজা নারী হয়ে যতই ঘরে সামাল দিয়ে ওঠেন না কেন, অনেক সময় পিছিয়ে আসতে হয় কর্মক্ষেত্র থেকে। যতই শিক্ষা ও ডিগ্রি থাকুক, যাতায়াতের নিরাপত্তা বা কর্মস্থলে অস্বস্তিসহ নানা কারণে নারীই সরে আসেন।
বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। মানব গোষ্ঠীর অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও নারীরা কি তাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু অর্জন করতে পেরেছে? আজকাল অনেক নারীনেত্রী বলেন, আজ আমরা স্বাধীন হয়েছি, কথাবলার মতো স্থান পেয়েছি, কিন্তু আসলেই কি তারা আজ স্বাধীন, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছেন? নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে দেখুন, উত্তরটা আপনার অজানা নয়।
আসলে নারীকে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে। আমাদের সমাজ এখনো নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে না দেখেই এই দুরবস্থা। সমাজের কিছু নারী তাদের মেধা, বুদ্ধি আর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে পেরেছে। কিন্তু সেটাই তো সব নয়। এখনো সমাজের ধারণা, নারীদের জন্ম হয়েছে পরের সেবা করার জন্য। পরের সেবা নারীরা অবশ্যই করবে, তাই বলে নিজের সবটুকু দিয়ে নয়, নিজেকেও ভালোবাসতে হবে নারীকে। কারণ নিজেকে ভালোবাসার মধ্যেই তো নারীর মুক্তি।
এদেশের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যায়ে নারীরা তাদের কর্মের স্বাক্ষর রেখেছেন। দিনে দিনে নারীদের ভূমিকা উজ্জ্বলতর হচ্ছে। কিন্তু আজ নারীরা এগোলেও সমানতালে এগোয়নি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা। এখনো তৈরি হয়নি নারীবান্ধব পরিবেশ। যদিও আমাদের দেশের সরকার প্রধান ও বিরোধী দলের নেতা দু’জনই নারী। এ কারণে কর্মক্ষেত্রে নারী নেতৃত্বের সর্বোচ্চ আসন ছুঁতে পারলেও আপন সমাজ-সংসারে এখনো অনেকে নিগৃহীত। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত অনেক নারী আজ নিজ গৃহেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। শুধু গৃহেই নয়, পথ চলতে গিয়ে বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে তাদের নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ধর্ষণের মতো লোমহর্ষক ঘটনা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর স্বাধিকার ও ক্ষমতায়নে স্বভাবতই কমবেশি সংকুচিত থাকে। কিন্তু নারীদের স্বাভাবিক মর্যাদাকে সুরক্ষা করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। এক্ষেত্রে আগের অবস্থাতেই রয়েছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে সমাজের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ গলা উঁচু করে আমরা বলি, নারীরা এখন আধুনিক সমাজে বসবাস করছে।
দিন আসে, দিন যায়। কিন্তু পরিবর্তন হয় না নারীদের অবস্থানের। উচ্চারিত হয় না নারীর প্রকৃত অধিকারের কথা। নারীরা ঠিকই নিষ্পেসিত, নির্যাতিত থেকে যায়। স্বামীর অত্যাচার সহ্য করা গ্রাম্য গৃহবধূ যেমন নিজের স্বাধীনতা অর্জনে ব্যর্থ, তেমনি বঞ্চিত ও নির্যাতিত শ্রমজীবী নারীরাও শুনতে পান না স্বাধীনতার গান। নারীদের প্রতিদিনই সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চলার প্রত্যয়ে পুরনো বছর হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। সেই সঙ্গে স্মৃতির চাদরে ডায়েরির পাতায় বন্ধি হয় আরেকটি বছর। কমে আয়ু, ফুরায় সময়। তাই সময়কে কাজে লাগাতে হবে। আরও পরিশ্রমী ও উদ্যমী হয়ে নারীকে পথ চলতে হবে। জীবন গঠনের স্বপ্ন নিয়ে পেরুতে হবে বহু আলপথ। অন্ধকার ফুঁড়ে যেমনি নতুন সূর্য উঠে আলোয় ভাসিয়ে দেয় পুরো পৃথিবী ঠিক তেমনি ঘুমিয়ে থাকা নারীদেরও জাগতে হবে। নারীর জীবন যেন একই বৃত্তে বৃত্তবন্দি না হয়। সেই সুদূর শৈশব থেকেই নারী একই বৃত্তের চক্রে ঘুরে ফিরছে। নতুন বছরে নারী সেই চক্র ভেদ করে বের হয়ে আসুক। নারীদের সময়ের সঙ্গে গতিশীল হতে হবে।
নতুন বছরে আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে নারীদের উন্নয়ন। যাত্রাপথে নারীদের হয়রানি, কর্মস্থলে অস্বস্তিকর পরিবেশ না থাকুক। পুরুষ সহকর্মীরা নারী সহকর্মীদের মানুষ হিসেবে দেখুক। প্রত্যেক দিনই হোক নারীর জন্য নিরাপদ। সর্বত্র গড়ে উঠুক নারীবান্ধব পরিবেশ। যেখানে তারা স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে, হতে পারে তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ। কোনো কলুষতা যেন নারীদের ছুঁতে না পারে। নারী নির্যাতনের কলঙ্কমুক্ত হয়ে গড়ে উঠুক আধুনিক রাষ্ট্র যেখানে নারী-পুরুষ সমানভাবে কাজ করবে দেশের জন্য।
মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো যেমন পাপ তেমনি নিজের ওপর আস্থা হারানো আত্মঘাতী। নারীকে আত্মঘাতী নয় বরং আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে। মনকে দৃঢ় করে সামনে চলবে নারী, মুখে বলবে, ‘হাতের মুঠোয় হাজার বছর, সামনে এগিয়ে চলবোই।’