আজও নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি কেন
‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী’, নারী সম্পর্কিত বহুল আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ এই মন্তব্যটি করেছিলেন খ্যাতনামা ফরাশি ঔপন্যাসিক, দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক সিমোন দ্য বোভোয়ার। প্রকৃত অর্থেই নারীকে আজকের সমাজে এসেও মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না। জন্মগ্রহণের পর পরিবার, সমাজ নারীকে শুধু নারী হয়ে ওঠার দিকেই ধাবিত করে। নারী সব কাজ করতে পারে না, সব কথা বলতে পারে না। নারীকে হতে হবে কোমলপ্রাণের অধিকারী। শক্তিসামর্থ্য দিয়ে কোনো কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না। হাজার রকম গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা হয় নারীকে। নারী মানেই যেন ‘না-বোধক’ কিছু। সবকিছুতেই এক সীমাবদ্ধতার জালে আটকে ফেলা হয় তাকে। একুশ শতকে এসে নারীর প্রতি পুরুষতন্ত্রের মানসিকতা কতটা পরিবর্তিত হয়েছে?
আজও নারীকে যে নারী রূপেই সমাজে গণ্য করা হয়, তা খুবই স্পষ্ট। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র নারীকে বেঁধে রেখেছে পরাধীনতা, দুর্বলচিত্ততায়। নারীকে মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা পরিবার, সমাজে আজও দেওয়া হয় না। নারীর ব্যক্তিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে তাকে স্বতন্ত্র মানব সন্তান হিসেবে মূল্যায়িত করা হয় না। নারী স্বাধীনতা এখনো ইট কাঠের পৃথিবীতে চার দেওয়ালে বন্দি। বিশেষভাবে মুসলিম দেশগুলো ও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে নারীদের অবস্থা আরও অধিক শোচনীয়। নারী শুধুই বিচার্য হয় জড়বস্তু রূপে। তাকে যেমন খুশি ব্যবহার করা যায়।
একুশ শতকে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু নারী আজও অন্ধকারে। সমাজের মানসিকতার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হলেও বৃহত্তর অংশ আজও তিমিরেই থেকে গেছে। সেই বৃহৎ অংশে আদৌ কোনোদিন আলো পৌঁছোতে পারবে কি না, সে বিষয়ে বেশ সন্দেহ থেকে যায়!
আমাদের সমাজে মূলত প্রাচীন যুগ থেকেই নারীকে গঠনগত দিক থেকে দূর্বল ভাবা হয়। কঠিন ও শ্রমসাধ্য কাজ নারীকে দিয়ে সম্ভব হবে না বলেই ধরে নেওয়া হয়। আবার নারী যদি সে কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করে তবু কটুকথা থেকে পরিত্রাণ পায় না।নারীর সঙ্গে সমাজের কেমন জানি একটা লুকোচুরির সম্পর্ক। ফলে নারী যতই তার জীবনের লক্ষ্যের দিকে এগুতে থাকে, ততই তাকে টেনে নিচে নামানোর পাঁয়তারা চলে।
নারী অর্থই হলো কোমলপ্রাণ, স্নেহপরায়ণ, হৃদয়স্পর্শী। এর ব্যতিক্রম কোনো নারী সত্তা আজও আমাদের চোখে ভাসে না। আমরা নারীকে পেতে চাই কোমলতা দিয়ে। আর এই কোমলতাকে সিঁদ কেটে তার ভেতরের সব লুটপাট করতে থাকে এ সমাজ! আর নারীর কোমলতাকে এ সমাজ বিচার করে তার দুর্বলতা, অক্ষমতা রূপে। কিন্তু সত্যি নারী কি শুধুই জড়তার নিদর্শন?
নারী হবে আলোর পথের দিশারী। সেই দিশায় সমাজ তথা দেশকে আলোকিত করে তুলবে। তাই আমাদের ভাবনার জগৎ প্রসারিত করে নারীকে তার পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হবে।
মানুষের হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন একই মাপের নয়, তেমনি সব নারীও সমান নয়। কেউ অধিক কোমল কেউ বা যন্ত্রিকতার চাপে পিষ্ট হয়ে বেশ আগেই কোমলতাকে ছাড়িয়ে এসেছে৷ কিন্তু সমাজ তাদের বিদ্রূপ করতে ছাড়ে না। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। নারী জড়বস্তু নয়। তাদের জীবনে টানাপড়েন আছে, দুঃখ-কষ্ট আছে, প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামের সংঘর্ষ আছে। তবে নারী কেনই বা শুধু একটি ধাঁচে গড়া গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে জীবনযাপন করতে পারবে না? নারীকে কেন নিক্তিতে মাপা হবে?
একই মানুষ তার স্থান, কাল অনুযায়ী বেড়ে ওঠে। আর মানুষের মানসিকতা গড়ে তার পরিপার্শ্ব ও সহচর্য অনুযায়ী। তাই মানুষের চিন্তার দৈন্যই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। চিন্তার সীমাবদ্ধতা মানুষের অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে এবং মানুষে মানুষে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আর তাই কাউকেই সর্বময় ক্ষমতা বা জ্ঞানের অধিকারী ভাবা উচিত নয়। প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের মতো। নারী বলেই যে সব নারী একরকম বা সব পুরুষ একই বৈশিষ্ট্যের হবে তা ভাবা ভুল। ফলে ব্যক্তিভেদে প্রত্যেককে তার মতো করেই গ্রহণ করতে হবে। যে কাজ পুরুষ করতে পারে তা নারী পারবে না, একজন নারী পারে বলেই অন্য একজন নারী- পুরুষ পারবেন, তা ভাবা যেমন অমূলক, তেমনি নারী হলেই তিনি ঘরে অবরুদ্ধ থাকবেন, তাকে দিয়ে কিছু হবে না, তা ভাবাও নিষ্ঠুরতা ও যুক্তিহীন।
আমাদের মানসিক প্রসারতা ঘটাতে হবে। মনের দীনতা দূর করতে হবে। একুশ শতাকে এসেও নারীরা কেন তিলে তিলে তড়পে মরবে? নারীদের এই হীন পরিস্থিতির জন্য কি আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র দায়ী নয়?
অবকাঠামোগত দিক থেকে এগুলোও মনের দিক থেকে কতটা অগ্রসর হতে পেরেছি আমরা? একজন নারী স্কুটি, সাইকেল চালালে, ফুটবল, ক্রিকেট খেললে বা কাজের জন্য রাত করে বাড়ি ফিরলে, সিঙ্গেল থাকলে, নাচ-গান করলে সমাজের বুকে আজও কেন ব্যথা বাজে? কেন স্বাভাবিকভাবে নারীর বিকাশকে আমাদের আধুনিক সমাজ মেনে নিতে পারছে না? তাহলে বলাই চলে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র ঠিক মাকালফল! মুখে যতই বড় কথা বলে বেড়াক ভেতরে দগ্ধতার পোড়া ছাঁই। নারীকে সমাজ যদি সুনজরে দেখে তবেই নারীরা মানুষ হয়ে উঠবে।
তাই নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতায়নের পাশাপাশি, পারিবারিক, সামজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নারীর দক্ষতা, যোগ্যতা বলে তার সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নারী হবে আলোর পথের দিশারী। সেই দিশায় সমাজ তথা দেশকে আলোকিত করে তুলবে। তাই আমাদের ভাবনার জগৎ প্রসারিত করে নারীকে তার পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হবে।