নৃত্যশিল্পী রাহিজা খানম ঝুনুর মৃত্যুবার্ষিকী আজ
পাকিস্তান আমলে নারীরা যখন সমাজে বেশ কোণঠাসা, তখনকার সময়ে পায়ে নূপুর জড়িয়ে অচলায়তন ভেঙ্গেছিলেন এক নারী। তাঁর নাম রাহিজা খানম ঝুনু। নৃত্যশিল্পী রাহিজা খানম ঝুনু অধিক পরিচিত নৃত্যগুরু হিসেবে। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন নৃত্য নিয়ে। দেশের নৃত্যশিল্পীদের অনুপ্রেরণা তিনি। আজ এই গুণী শিল্পীর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী।
ঝুনু ১৯৪৩ সালের ২১ জুন তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) মানিকগঞ্জ জেলায় এক শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবু মোহাম্মদ আবদুল্লাহ খান ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার এবং মাতা সফরুন নেছা। ঝুনু ছোটবেলায় কলের গান বাজিয়ে বাড়িতে নাচতেন। তার বাবা এতে খুশি হয়ে তাকে গেন্ডারিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে (মনিজা রহমান গার্লস স্কুল) ভর্তি করান। যেখানে তিনি পড়াশুনার পাশাপাশি নাচ ও গান শিখেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বাসন্তী গুহঠাকুরতা প্রতি বছর স্কুলে নাচ ও গানে প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। ১৯৫৫ সালে ঝুনু পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন বাসন্তী গুহ “ঘুমন্ত রাজকন্যা” নামে একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। এতে ঝুনু একটি পুরুষ চরিত্রে নাচে অংশগ্রহণ করেন। এই নৃত্যনাট্যের নৃত্য পরিচালক ছিলেন অজিত সান্ন্যাল। তিনি ঝুনুর পিতাকে বলেন তাকে বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে ভর্তি করতে। ১৯৫৬ সালে ঝুনু নৃত্যে তালিম নিতে বাফায় ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বাফার প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী।
ঝুনু বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে ভর্তি হওয়ার পর বেশ কয়েকটি নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করেন। বাফায় ভর্তির পরের বছর ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বাফার নিউ পিকচার হাউসে মঞ্চস্থ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য চন্ডালিকায় চুড়িওয়ালা চরিত্রে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে জি এ মান্নান বাফায় নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেন। ঝুনু এই নৃত্যনাট্যে সাজু চরিত্রে অংশগ্রহণ করেন। তিনমাস ব্যাপী অনুশীলনের পর নৃত্যনাট্যটি ইস্কান্দার মির্জা হলে (বর্তমান ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট) মঞ্চস্থ হলে এর পরিচালক এবং অংশগ্রহণকারীদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর, ইরাক ও ইরানে এই নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করে। ইরানে ঝুনুর কাজ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।
১৯৬০ সালে বাফা থেকে পাস করে তিনি বাফার নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৮ সালে অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঝুনু এসময়ে বেশ কিছু নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেন এবং অংশগ্রহণ করেন। ডঃ এনামুল হক রচিত সূর্যমুখী নদী, উত্তরণের দেশে, হাজার তারের বীণা নৃত্যনাট্যসমূহ পরিচালনা ও অংশগ্রহণ করেছেন। উত্তরণের দেশে নৃত্যনাট্যটি একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর ভিত্তি করে রচিত এবং সূর্যমুখী নদী গীতি-নৃত্যনাট্যটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রযোজনায় দি ম্যালডি নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেন। শিশুদের জীবনভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য দেখব এবার জগত্টাকে পরিচালনা করেছেন। নৃত্যকলায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯০ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে।
ব্যক্তিগত জীবনে রাহিজা খানম ঝুনু ১৯৬৬ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি আমান উল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই মেয়ে লোপা ও ফারহানা চৌধুরী বেবী দুজনেই লোক ও আধুনিক ধারার নৃত্যশিল্পী। নাচের সঙ্গে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পার করে ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে রাজধানীর ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭৪ বছর। দেশ বরেণ্য এই নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যশিক্ষক রাহিজা খানম ঝুনুর মৃত্যু্বার্ষিকীতে পাক্ষিক অনন্যার পক্ষ থেকে রইল গভীর শ্রদ্ধা।