নাসিক নির্বাচনের চোখ দিয়ে গণতন্ত্র ও শান্তির অন্বেষণ
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সারা দেশের চোখ ছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের দিকে। আমিও মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলাম এ নির্বাচনের পারদের ওঠানামা। নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী টানা তিন বার মেয়র পদে জয় পেলেন। এটা দারুণ একটা ইতিহাস। বিশেষ করে একজন নারীর জন্য। এর আগে সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে টানা তৃতীয় মেয়াদে জয় পেয়েছিলেন চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তার মতো ইতিহাস সৃষ্টি করলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী তিনি শুধু জয়লাভই করেননি, জয়ের ব্যবধানটাও বিশাল, প্রায় ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন আইভী। এবারের এই নির্বাচনটি বিভিন্ন দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আমাদের পরবর্তী নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে নাসিকের এই নির্বাচনটি দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
নাসিকের এবারের নির্বাচন প্রচারের শেষ মুহূর্তে, অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারি রাতে ডিবিসি টেলিভিশনে রাত ১০টার দিকে সরাসরি একটি লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানটির শেষ এক ঘণ্টা আমি মনোযোগ দিয়ে দেখি। সেখানে নাসিক নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জনাব তৈমূর ও নৌকার প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী—দুজনেরই অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও জনাব তৈমূর যে কোনো কারণে হোক অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু আমাকে দারুণভাবে বিস্মিত করেছে আইভীর স্মার্টনেস। তিনি ডিবিসির বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এমনভাবে দিচ্ছিলেন যে, মনে হচ্ছিল নারায়ণগঞ্জ নিয়ে এমন কোনো বিষয় নেই যেটা দিয়ে আইভীকে পরাস্ত করা যায়। আইভীর উত্তরদানের অসাধারণ আত্মবিশ্বাসের ছাপ দেখতে পাই। এটা আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে নারী নেতৃত্বের যোগ্যতা কোন পর্যায়ে গেছে, তার একটি উদাহরণ আইভী স্বয়ং। এর সঙ্গে উল্লেখ্য করতেই হয় নাটোর পৌরসভা নির্বাচনের বিজয়ী মেয়র উমা চৌধুরী জলির কথা। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—আইভী ও জলি, দুজনেই নৌকার প্রার্থী। এই পয়েন্টের সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে, এই দুজনের সঙ্গেই স্থানীয় দলীয় সাংসদদের সম্পর্ক ভালো নয়। বলার অপেক্ষা না রাখে, এজন্য এদের কত প্রতিকূলতার স্রোত ঠেলেই না এগোতে হয়েছে! নারীরা যে ভয়ংকর কঠিন বাধার বিন্ধ্যাচলও গুঁড়িয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারেন—আইভী কিংবা জলি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আমি নোটিশ করলাম, নাসিকের নির্বাচনী প্রচারণার শেষ রাতে ডিবিসির সেই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানের প্রশ্নকর্তার যে কোনো বাউন্সার আইভী কেবল দক্ষতার সঙ্গে সামলাচ্ছিলেন না, তিনি একই সঙ্গে উত্তর দিচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জের বেশ অনেক জন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের একাংশের প্রশ্নের এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়ার। যদিও প্রশ্নকর্তাদের এই অংশে একজনও গুরুত্বপূর্ণ নারী নারায়ণগঞ্জবাসী ছিলেন না। আইভীর বিভিন্ন উত্তর শুনে আমি স্পষ্টই বুঝতে পারলাম যে, নারায়ণগঞ্জ শহরের মেয়র হিসেবে আইভী শহরটাকে নিজ হাতের তালুর মতোই পরিষ্কার জানেন, চেনেন ও বোঝেন। নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডের অবস্থা এবং এদের প্রয়োজন বা সমস্যা এবং বিবিধ পরিসংখ্যান আইভীর মস্তিষ্কে কম্পিউটারের মতো গেঁথে আছে যেন। যে প্রার্থী তার এলাকা এবং এর পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধে এত স্বচ্ছ ধারণা রাখেন, সেই প্রার্থীকে লাইভ সাক্ষাৎকারে মোকাবিলা করার সাহস লাগে। সুতরাং সেই রাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জনাব তৈমূর আলম ডিবিসির সেই অনুষ্ঠানে কেন অংশ নেননি, সেটা অনুমান করা যায় বটে।
সত্যিকারের যোগ্য নেতা হওয়া তো এত সোজা ব্যাপার নয়। সততা, বুদ্ধি, প্রকাশের ক্ষমতা, বিচারক্ষমতা, প্রশ্ন করার মন, মতামত বা নানান মতামত সংগ্রহের ইচ্ছা, তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা, ভালো স্মৃতিশক্তি, সাহস, দূরদর্শিতা, সীমাহীন উৎসাহ এবং চিন্তাভাবনায় আধুনিক ও নমনীয় হওয়া—এসব গুণ না থাকলে ভালো নেতা হওয়া যায় না। আইভীর মধ্যে এর প্রায় সবগুলো গুণই দেখা যায়। কিন্তু তার প্রতিপক্ষের কী কী গুণ আর নির্গুণ আছে—সেটা মোটামুটি সবাই জানেন। সেলিনা হায়াৎ আইভীর নারায়ণগঞ্জেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তার পিতার রাজনৈতিক ইতিহাস কারো অজানা নয়। অর্থাত্ রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যেই তিনি বড় হয়ে উঠেছেন। গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত জনাব সোহরাব হাসানের ‘কলাগাছ নয়, ম্যারাডোনাই জিতিয়েছে নৌকাকে’ লেখাটির শিরোনাম আমার কাছে খুব তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।
নৌকার মার্কার জন্য কেবল আইভী জেতেননি, তিনি ম্যারাডোনার মতো বাজিমাত করা পারফরমান্স দেখিয়ে জয়লাভ করেছেন। এ ব্যাপারে আমরা আগের নির্বাচনগুলোর পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বোলাতে পারি। ডা. আইভী ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনে সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায়ও ২০০৩ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঐ সময় থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পৌরসভার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে পরাজিত করে জয়ী হন আইভী। ঐ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে আইভী ভোট পান ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১টি। আর সাখাওয়াত হোসেন খান পান ৯৬ হাজার ৪৪টি৷ ঐ বছর তিনি ধানের শীষের প্রার্থীর চেয়ে ৭৯ হাজার ৫৬৭ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। আর এবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে ৬৯ হাজার ১০২ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন তিনি। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনটি, যেটা অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর। এতে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে ১ লাখেরও বেশি ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সেলিনা হায়াত্ আইভী। আইভী কিন্তু তখন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবেই জয়লাভ করেছিলেন। তিনি শামীম ওসমানকে লাখখানেক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। শামীম ওসমান এবার বলেছেন—‘প্রার্থী কলাগাছ না আমগাছ সেটি বিষয় নয়, নৌকা জিতবে। আমরা নৌকার পক্ষে কাজ করব।’ এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০০১ সালের নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের একটি আসনেও নৌকা জেতেনি এবং সেলিম ওসমানের বড় ভাই নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টির (জাপা) হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।
আমার মনে হয়েছে, গত দুই দশক ধরে আইভী এটাই প্রমাণ করেছেন যে—দল বড় নয়, দেশের জন্য ভালোবাসা বড়। গত ১০ বছরে তিনি তার যোগ্যতায় নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে গেছেন, বারবার উত্তীর্ণ হয়েছেন অগ্নিপরীক্ষায়। আইভী জানেন, বোঝেন এবং সেভাবেই কাজ করে গিয়েছেন গত ১০ বছর। যথার্থই আইভী তার মাঠের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়, তিনি ক্যারিশম্যাটিক খেলোয়াড় ম্যারাডোনার মতোই অতুলনীয়। আমি লক্ষ করেছি, আইভী তার এবারের নির্বাচনি প্রচারণায় একবারও তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে একটি খারাপ শব্দও বলেননি। তিনি সর্বক্ষণ তাকে ‘কাকা’ বলেই সম্বোধন করেছেন। আইভী জানেন কীভাবে প্রচার চালাতে হয়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে একটুও কটূক্তি না করে প্রচারণা চালানো যায়। নিঃসন্দেহে, আইভীর ব্যক্তি-ইমেজই নৌকাকে বিপুল ভোটে এগিয়ে দিয়েছে। আইভীর এই হ্যাট্রিক জয় আমাদের মনে অনেক ধরনের চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। নেতৃত্ব দেওয়ার অনেক গুণই (গণতন্ত্রের এই দুর্দিনে) আইভীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলির কয়েকটি পঙক্তি :‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/ পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’
বিখ্যাত প্রবন্ধকার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক আর্চি ব্রাউন তার ‘দ্য মিথ অব দ্য স্ট্রং লিডার/ পলিটিক্যাল লিডারশিপ ইন দ্য মডার্ন এজ’ বইতে বলেছেন, ‘নেতার গ্ল্যামার, ক্যারিশমা, জনপ্রিয় জনমোহিনী শক্তি, যা-ই হোক না কেন আসলে নেতৃত্ব শক্তিশালী হতে পারে একমাত্র যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমেই।’ মহামতি চাণক্যের সূত্রতেও নৈতিকতার কথা বলা হয়েছে বারবার। তার সূত্রের প্রথমেই বলা হয়েছে, রাজাকে সত্য হতে হবে। অসত্য অন্যায়ের মাধ্যমে রাজধর্ম পালন হবে না। রাজা শক্তিশালী হবে না। আর গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট যে, এই তন্ত্রে অন্যের প্রতি সহিষ্ণু হতেই হবে। পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক। যদি বিরোধী দলের মতের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা না দেখানো হয়, তাহলে সে দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতারও বিকাশ সম্ভব নয়। গণতন্ত্র ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতারও বিকাশ সম্ভব নয়। অথচ পরিপূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সামাজিক অর্থনৈতিক ও মানসিক বিকাশ অপরিহার্য| আমরা আজকাল ‘বিশ্বায়ন’ শুনতে শুনতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাচ্ছি, আমরা আসলে কী? অনেকেই মনে করেন, বিশ্বায়ন তো শুধু রাষ্ট্রের ক্ষমতা ওপরের দিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যায়নি, বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্র অনেক ক্ষমতা নিচের দিকেও হারাচ্ছে। চারদিকে বিকৃত ও জটিল পরিবর্তন দেখে মনে হয়—‘তোমরা একতারা বাজাইয়ো না/ দোতরা বাজাইয়ো না/ একতারা বাজাইলে মনে পইড়া যায়/ একদিন বাঙালি ছিলাম রে।’
এটা মনে রাখতে হবে, মানুষ আন্তর্জাতিক ব্যবস্হার ক্রীড়নক হতে চায় না। মানুষ শান্তি চায়। রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে চায়। আমরা দেখছি পারছি, রাষ্ট্রব্যবস্হায় বিভিন্ন ধরনের সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমরা বুঝতে পারছি, মাঠপর্যায়ে সর্বত্রই বিশ্বায়নের বিপক্ষে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। মানুষ আসলে এসব অস্বস্তিকর ও দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। রবীন্দ্রনাথের গানের কথাগুলো মনে মনে আওড়াই—‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার।/ তাই জনম গেল, শান্িত পেলি না রে মন, মন রে আমার।’ এই মনে শান্তি আমরা কোথায় পাব, সে উত্তর আমাদের কারো কি জানা আছে?
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা