বাঙালি সাবধান হও!
সেই ধ্বংসস্তূপের তলে চাপা পড়া সদ্য স্বাধীন দেশটিকে নিয়ে তখন বিশ্বের অনেকেই ঠাট্টা করতেন। তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তো সে সময় বাংলাদেশকে একটি ‘বাস্কেট কেস’ বলেছিলেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রথম রিপোর্ট করেছিল ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। সেখানে বলা হয়েছিল—সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এ বিষয়ে আমরা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের কথা স্মরণ করতে পারি। বইটির নাম—‘বাংলাদেশ দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’।
নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন এই গ্রন্থে বলেছিলেন—বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে, যে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে।
কিন্তু বাংলাদেশ সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখাল! উন্নয়নের যে মহিসোপানে প্রবেশ করে আমরা এই বিশ্বকে চমকে দিয়েছি, তার এক্সিলেটরে সবচেয়ে ভালো চাপ পড়েছে গত এক দশকে। ২০০৯-২০১৩ সালের মধ্যেই এদেশের বিদ্যুতের উত্পাদন চার গুণ বেড়েছিল। ৫ কোটি মানুষ নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষি কার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বিনা জামানতে বর্গাচাষিদের ঋণ প্রদান, চিকিত্সাসেবার জন্য সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি। ২০১৪ সালের পর থেকে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান উন্নয়নের বয়ান দিতে গেলে এ লেখা নির্দিষ্ট পরিসরে শেষ করা সম্ভব হবে না।
নিশ্চয়ই বাংলাদেশের হাতে কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই। কী আছে তাহলে! আমরা অত্যন্ত স্বস্তির সঙ্গে বলতে পারি, বাংলাদেশের আছে একজন শেখ হাসিনা। না, ব্যাপারটা একপেশে স্তুতি নয়। শেখ হাসিনাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। অনেকেই বলে থাকেন, শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছেন, বহু ক্ষেত্রেই বাক্স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন। কিন্তু যেসব দেশ গণতন্ত্রের নামে চলছে, সেখানেও কি কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র আছে? কথিত একনায়কতন্ত্র এখন সারা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই একনায়কতন্ত্র যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সেটা কিন্তু দারুণ ব্যাপার, যেই উদাহরণটা আমরা সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে দেখতে পেয়েছি। আমরা আধুনিক সিঙ্গাপুরের রূপকার লি কুয়ান ইউ-এর দীর্ঘমেয়াদি জমানা দেখেছি। লি কুয়ান সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘স্বর্গভূমি’তে পরিণত করতে পেরেছিলেন।
উন্নয়নের পাশাপাশি আমরা এসব রাজনৈতিক বিষয় যৌক্তিকভাবে বুঝে দেখতে চেষ্টা করি। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের পরপর তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন। এটা বিএনপির দুর্বলতা হোক কিংবা সঠিক সিদ্ধান্তের অভাব হোক—তারা ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এতে করে তারা পিছিয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের তুলনায়। এটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা হতে পারে, খালেদা জিয়ার অদূরদর্শিতাও হতে পারে। যা-ই হোক না কেন, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, নেতৃত্বের অভাবে বিএনপি আজ পেছনে পড়ে গেছে রাজনীতির খেলায়। রাজনীতিতে তো একটা স্ট্র্যাটেজি থাকেই। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেও বিএনপি এর আগে দুই দফায় ক্ষমতায় এসেছিল। প্রথম দফায় ১৯৯১-’৯৬ পর্যন্ত তুলনামূলক ভালোই দেশ চালিয়েছিল বলা যায়। কিন্তু বিএনপি তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কফিনে একের পর এক পেরেক ঠুকেছে ২০০১-২০০৬ সালের জমানা। এই জমানায় বিএনপির তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর বংশধররা এক ভয়াবহ অরাজকতা শুরু করে দিয়েছিল। সবকিছুতেই দলীয়করণ করার নীতিহীন কাজের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত তারাই সবচাইতে খারাপভাবে তৈরি করেছিল। এমনকি তত্কালীন বিরোধী দলের শীর্ষনেত্রীকে হত্যা করতে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনাও ঘটাতে থাকে। শেখ হাসিনাকে কতভাবেই-না হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে! এ এক ভয়াবহ হীন-কুিসত রাজনীতি।
২০০৮ সালে শেখ হাসিনা যখন বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসেন, তখন থেকেই শুরু হয় নতুন এক বাংলাদেশের অভিযাত্রা। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ক্ষমতায় আছেন শেখ হাসিনা। আর, তারই সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। তার স্বীকৃতি মিলছে বাকি বিশ্বের কাছ থেকেও। যদিও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। আমরা দেখেছি, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। তবে রাজনৈতিকভাবে পোড় খাওয়া শেখ হাসিনা এই জমানায় অনেক বেশি সংযত ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। প্রশাসনযন্ত্রে বিএনপির জমানায় বিশেষ নীতিহীন উপায়ে প্রবেশ করা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারীদের শক্ত হাতে নির্মূল করেন তিনি। তবে সেটা ষড়যন্ত্রের শীর্ষে যারা বসেছিলেন, তাদের মধ্যে অল্প কয়েক জনকে কেবল চিহ্নিত করা গিয়েছিল। সর্বশেষ জমানায় অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থের তো অভাব নেই বিএনপির। সঙ্গে দোসর আছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত। এখন সেসব অর্থের মাধ্যমেই তারা বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। ষড়যন্ত্রই তাদের এখন সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
এর পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাইরের অনেক ধান্দাবাজ লোক সরকারের তথাকথিত অনুরাগী সেজে অনুপ্রবেশ করেছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে। সম্প্রতি আলোচিত হাজি সেলিমের কথাই ধরা যাক। তিনি ঘটনাচক্রে নৌকায় উঠে পড়েছিলেন, প্রকৃতপক্ষে নীতিগতভাবে তিনি আগে থেকেই ধানের শীষের বাহক ছিলেন। সত্যিকার অর্থে, সারা দেশে এমন হাজারো হাজি সেলিম আছেন। আজকে যে পরিমাণ অনুপ্রবেশকারী বের হচ্ছে, তা দেখে মনে হয় ষড়যন্ত্রকারীরা বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা বেশ ভালোমতোই তৈরি করতে পেরেছে। কথা হলো, যেসব বড় নেতার হাত ধরে নৌকায় উঠে পড়েছেন শত শত অনুপ্রবেশকারী, দলের সেসব বড় নেতারা যদি শেখ হাসিনাকে সঠিক পরামর্শ না দেন, সঠিক মানুষদের দলে প্রবেশ করাতে সহযোগিতা না করেন, তাহলে হাজি সেলিম কিংবা নোয়াখালী-সিলেটে যা ঘটছে, সেটা ঘটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু যারা সত্যিকারের বঙ্গবন্ধুর আদর্শনীতি নিয়ে চলেন, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি, তারা কিন্তু ঠিকই তাদের এলাকাগুলোকে বিপথগামী হতে দিচ্ছেন না, এ রকম সংসদ সদস্যও অনেক আছেন।
আমরা এটাও দেখতে পাচ্ছি, কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায় ৩৫ বছর ধরে উন্নয়ন অব্যাহত রাখার পরও সেখানে বড় নেতার পোষ্য লোকজনই আওয়ামী লীগের নামে তাদের আগের নেতাকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে দ্বিধা করছে না। এসব অনুপ্রবেশকারী এমন ভাব দেখায় যে, আওয়ামী লীগ করলেই যেন দেশকে ভালোবাসা যায়। এখন প্রশ্ন হলো, এটা কি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দোষ, নাকি তার যারা পরামর্শক আছেন, যারা কমিটির শীর্ষ পদে আছেন, তাদের দোষ? এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নামে যেসব অপরাধ ও অরাজকতা করা হচ্ছে, তাতে শেষ অর্থে বদনাম হচ্ছে শেখ হাসিনারই। আমরা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে দেখছি, শেখ হাসিনাকে নিয়ে কত ধরনের আজেবাজে কথা বলে হচ্ছে। কারা এসব করছে? যারা স্বাধীনতাবিরোধী, বাংলাদেশের উন্নয়নবিরোধী—এরা মূলত তাদেরই বংশধর। তারাই এখন সুবিধামতো নানান রূপে—কখনো বিএনপি, কখনো জামায়াত, কখনো নব্য আওয়ামী লীগ, কখনো তথাকথিত দেশপ্রেমিকের ভেক ধরে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। ভারতকে তারা সব সময়ই কমন শত্রু ধরে নিয়ে বিপুল প্রপাগান্ডায় মেতে উঠেছে।
সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, ধর্মের জন্য শেখ হাসিনা যেভাবে কাজ করেছেন, তা অনেক ধনী মুসলিম দেশও করেনি। এর পরও কতিপয় ষড়যন্ত্রকারীরা শেখ হাসিনাকে মুসলিমবিরোধী, ভারতের দালাল এবং সংখ্যালঘু তোষণকারী বলে থাকেন। দেশের উন্নতির স্বার্থে শেখ হাসিনার নীতি যদি হয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক, তাহলে সেটাকে কেন প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে? আর একটি দেশের সংখ্যালঘুরা যদি অনিরাপদ থাকে তবে কি সেটা লজ্জার নয়?
কিছু ভিন্ন দলের নেতা আছেন, যারা নীতিকথা বলতে ওস্তাদ, অথচ নিজের এলাকায় একটি সাঁকোও কখনো তৈরি করে দিতে পারেননি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আজকাল প্রশাসনকেও উসকানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে একটি বিশেষ দলের মতাদর্শের মাধ্যমে যারা প্রশাসনে ঢুকেছেন, তাদের একটি অংশ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। বিভিন্ন সেক্টরে যেসব সুবিধাবাদী সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ফায়দা লুটেছেন, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির পাশাপাশি ষড়যন্ত্রের কাজটিও ভালো মানুষ সেজে করে যাচ্ছেন।
আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত রাখছি। বিদ্যুত্ উত্পাদনে দেশ এখন অভাবিত উচ্চতায় চলে গেছে। এটা নিয়েও নিন্দুকদের নিন্দার শেষ নেই। কুইক রেন্টাল কিংবা রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বলা হচ্ছে, রামপাল সুন্দরবন ধ্বংস করে দেবে, জলবায়ু পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের শিল্পকারখানা এবং উন্নতির জন্য আমাদের প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন। আর এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোই সবচেয়ে বেশি দায়ী। বড় বড় দেশি-বিদেশি পত্রিকায় ইংরেজিতে লেখা হয়, রামপালের বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যেসব দুর্ভোগ বাংলাদেশের ওপর নেমে আসছে এবং আসবে, তার সিংহভাগের জন্য যে শিল্পোন্নত দেশের গ্রিনহাউজ গ্যাসই দায়ী, সে কথা কেউ বলে না।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের শেষ নেই আমাদের দেশে। এই কোভিডের মধ্যেও কিন্তু আমরা দেখছি অনেক লোকের চাকরি গেছে। সারা দুনিয়াতেই সেটা হচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। করোনায় যেখানে সারা বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে তখন শেখ হাসিনা পুরো টালমাটাল পরিস্থিতিতে যথেষ্ট নিপুণ হাতে সামলেছেন। সুতরাং আমাদের বুঝতে হবে—কে আমাদের জন্য ভালো, কে আমাদের শত্রু। আওয়ামী লীগকে শত্রু বানিয়ে আখেরে দেশের লাভ হবে কি? বঙ্গবন্ধু এদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। তার কন্যার দ্বারা কখনই এদেশের অমঙ্গল হতে পারে না। সেজন্য শেখ হাসিনাকে সবার ঊর্ধ্বে তুলে আমাদের এ উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। এই সোনার দেশের উন্নতির গ্রাফ যেভাবে ওপরের দিকে ছুটছে, সেটাকে নষ্ট করাটা হবে দেশের অপূরণীয় ক্ষতির শামিল। এদেশ সোনার দেশ! একে রক্ষা করা জরুরি। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান হও হে দেশপ্রেমিক বাঙালি!
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা