নারীর জন্য নিরাপদ হোক নতুন বছর
নতুন বছর কিংবা পুরনো বছর যাই হোক না কেন নারীরা কোনো অংশেই থেমে নেই। ২০২১, গোটা বছর জুড়েই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অনন্যারা। তাদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টাও নেহাত কম হয়নি। হয়রানি, নির্যাতন, অত্যাচার, ধর্ষণ, খুন বিভিন্ন সময় দেশ বিদেশ জুড়ে আলোচনায় এসেছে বিভিন্ন ঘটনা।
২০২১ সালে যেমন নারীরা তাদের সফলতা দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। বিভিন্ন ইস্যুতে নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগেছেন। বলাই বাহুল্য বাংলাদেশ নারীদের জন্য এখনো পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারেনি।
২০২১ এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বহুল আলোচিত সমালোচিত কয়েকটি ঘটনায় একটু চোখ বুলানো যাক।
শেষ থেকেই নাহয় শুরু করি তবে আপনাদের স্মরণ করতেও বেশ সুবিধাই হবে বৈকি। বর্তমান সময় সবথেকে আলোচনার ইস্যু কক্সবাজারে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনা৷ বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুসারে, সম্প্রতি কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হন এক পর্যটক নারী।
গত ২২ ডিসেম্বর বিকেলে স্বামী ও আট মাসের সন্তানকে নিয়ে সৈকতের লাবনী পয়েন্টে নামেন সৈকতে ভ্রমণে আসা ঐ নারী। বালুচর দিয়ে হেঁটে পানির দিকে নামার সময় তাঁর স্বামীর সঙ্গে একজনের ধাক্কা লাগে। এর জের ধরেই সন্ধ্যায় ওই নারীকে তুলে নিয়ে প্রথমে ঝুপড়ি একটি চায়ের দোকানে এবং পরে কলাতলীর জিয়া গেস্ট ইন হোটেলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়।
দেশজুড়ে এ ঘটনা আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি করে। এমনকি পুলিশ প্রাথমিক তদন্তের পর ঐ নারীর সাথে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা আছে বলে ধারণা প্রকাশ করেন৷ পুলিশের ভাষ্যমতে ঐ নারী দীর্ঘদিন যাবৎ কক্সবাজারে অবস্থান করছিলেন।
তবে র্যাব তদন্ত করে জানায়, ভুক্তভোগী ওই নারী স্বামী-সন্তানসহ কক্সবাজারের একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তাদের সঙ্গে ৮ মাস বয়সের একটি শিশু সন্তান রয়েছে। শিশুটির জন্মগতভাবে হার্টে ছিদ্র থাকায় তার চিকিৎসায় ১০ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। শিশুটির চিকিৎসার অর্থ সংকুলানের আশায় স্বামীসহ কক্সবাজারে অবস্থান করছিল পরিবারটি। তারা বিত্তবান পর্যটকদের নিকট হতে অর্থ সাহায্য চাইতেন।
দিনশেষে সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় ঐ নারী কক্সবাজারের পর্যটক ছিলেন না, তিনি স্বামী সন্তানসহ ঘুরতে যাননি, তবে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এবার নাহয় সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সামনে তরুণী ধর্ষণের ঘটনার দিকে নজর দেয়া যাক। ২০২১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে স্বামীকে নিয়ে শাহপরান মাজারে বেড়াতেই গিয়েছিলেন নির্যাতনের শিকার তরুণী।
ফেরার সময় তারা গাড়ি থামিয়েছিলেন নগরের টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে। স্ত্রীকে প্রাইভেটকারে রেখে স্বামী পার্শ্ববর্তী দোকানে গিয়েছিলেন। ওই সময় প্রাইভেটকারটি ঘিরে ধরে কয়েকজন তরুণ। প্রাইভেটকারসহ ওই দম্পতিকে তারা নিয়ে যায় বালুচর এলাকার এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ভেতরে। সেখানে স্বামীর সামনেই গাড়ির ভেতর সংঘবদ্ধভাবে তরুণীকে ধর্ষণ করে ছয় তরুণ।
এবার একটু ভিন্ন ধরনের ঘটনায় যাওয়া যাক। সাহসী, স্বাবলম্বী নারীরা আজকাল একা পথ চলতে দ্বিধা বোধ করেননা৷ সমাজও নারীদের তথাকথিত অনেক সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। আবার সেই সুযোগের মধ্যেই নারীকে হয়রানি করা হচ্ছে। গণপরিবহনে নারীর সংরক্ষিত আসন যেমন রয়েছে, তেমনি ঐ গণপরিবহনই যেনো ধর্ষকদের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে৷
২০২১ সালের মে মাসের শেষের দিকে আশুলিয়া সিএন্ডবি বাইপাস সড়কে একটি বাসে গণধর্ষণের শিকার হয় এক তরুণী। তিনি 'নিউ গ্রাম বাংলা পরিবহন' নামে একটি বাসে উঠেন টঙ্গী যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পথে আশুলিয়া গরুর হাট এলাকার আগেই ওই বাসের অন্য যাত্রীদের নামিয়ে বাস আবার নবীনগরের দিকে নিয়ে যায় চালক। এরপর বাস চলন্ত অবস্থায় বাসের দরজা জানালা বন্ধ করে তাকে ধর্ষণ করে চালক ও হেলপারসহ অন্যান্যরা।
গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উপজেলার মদনপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে চলন্ত বাসে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এর আগে ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর রাজধানীর একটি বাসে অর্ধেক (হাফ) ভাড়া দেওয়ায় প্রকাশ্যে এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে গণপরিবহনে ৬৮টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৩টি ধর্ষণ, ১১টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ৩৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে।
উল্লেখযোগ্যহারে ধর্ষণের শিকার হয়েছে শিশুরাও। ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয় মাত্র ১২ বছর বয়সী এক পথশিশু। যে ঘটনা আলোচনায় আসে পুরো দেশজুড়ে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে ভাসমান পথশিশু হিসেবে থাকত। ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যান সিদ্দিক নামের এক বখাটে। পরে কেরানীগঞ্জে নিয়ে তাকে একটি রুমে বন্দী করে ধর্ষণ করেন সিদ্দিক ।
আসক তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব মতে, ২০২১ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৫৯৬ শিশু।
এছাড়াও ২০২১ সালেই মন্ত্রণালয়ে এক নারী সাংবাদিককে হেনস্তার মতো নিন্দনীয় ঘটনা ঘটে। যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন তৈরির জন্য প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয় এবং সর্বশেষ নামেমাত্র মামলা দায়ের করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়৷
অনেকেই হয়তোবা এসব ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতে বলবেন বাইরের দুনিয়া নারীর জন্য নিরাপদ নয়। তাহলে ২০২১ এর শেষের দিকের একটি ঘটনায় চোখ বুলানো যাক। জয়পুরহাট সদর উপজেলায় ঘরে ঢুকে এক গৃহবধূকে (৩২) সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তিন যুবকের বিরুদ্ধে।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহামারির মধ্যেও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ সময় দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মোট ঘটনা ঘটে ২১ হাজার ৭৮৯টি যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ১৮ হাজার ৫০২টি। সে হিসাবে এক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
অন্য দিকে নারী নির্যাতনের ঘটনা এক বছরে ১২ হাজার ৬৬০টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ হাজার ৫৬৭টি হয় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ১০৭ জন নারীর মৃত্যু হয় স্বামীর নির্যাতনে। পারিবারিক সহিংসতার কারণে ৯২ জন নারী আত্মহত্যা করেন। ৪১ জন নারীকে তার নিজ পরিবারের লোকজন হত্যা করে।
সংস্থাটির তথ্যমতে, এ সময় ১ হাজার ১০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ২৩৪ জন। ২৮৬ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এ জন্য মোট মামলা হয় ৮৬৪টি। ১১ মাসে মোট ১০৯ জন নারী ও তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন। এদের মধ্যে ১০ জন আত্মহত্যা করেন। আর মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর দেওয়া তথ্যে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে মোট ৫৫ জন গৃহবধূর অকাল মৃত্যু হয় এবং নির্যাতনে ৯৭ জন আহত হন।
শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২১: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় , আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ৪৫ নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পরবর্তী সময়ে মারা যান ৩ নারী। অন্যদিকে এ বছরে অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ২৩ নারী।
এমন বহু ঘটনা রয়েছে যা এসব পরিসংখ্যান পর্যন্ত পৌঁছোতেও পারেনি। ২০২১ সাল জুড়ে নারীদের অনেক সফলতাও রয়েছে। দেশের নামও উজ্জ্বল করেছেন বহু নারীরা। একই মুদ্রার এপিঠ যখন উজ্জ্বল ছিলো অন্যপিঠ ছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবে নতুন বছরে প্রত্যশা নারীর সফলতার পথে এসব বাঁধা যেনো দূর হয়, দেশ যেনো নিরাপদ হয় নারীর জন্য।