মানবতা যেখানে অমলিন
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানবতার ডাকে মানুষ ছুটে এসেছে। মানবসেবা পরম ধর্ম। অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে একদল মানুষ চিরকালই নিজেদের স্বার্থ ছাড়াই এগিয়ে এসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আর সেই পথের অনুসারী হয়ে টাঙ্গাইলের 'শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন' এগিয়ে যাচ্ছে এই গল্পগুলোতে নিজেদের কথা আলাদাভাবে তুলে ধরতে।
একটা ছোট্ট চার দেয়ালের ঘরে একদল তরুণ, নিজেদের দায়িত্ব নেয়ার সামর্থ্যও তাদের তৈরি হওয়ার কথা ছিল না। অথচ এই এরাই দায়িত্ব নিয়েছে কতগুলো অসহায় ছিন্নমূল মানুষের। ছিন্নমূল শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে প্রয়োজনের তাগিদে তাদের কাজের পরিধি হয়ে উঠেছে আরো বিস্তৃত।
সম্পূর্ণ অলাভজনক এই সংস্থাটি ছিন্নমূল শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দেয়ার জন্য গড়া 'স্বপ্নপুরী স্কুল' দিয়ে যাত্রা শুরু করে, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুঈদ হাসান তড়িৎ। বিন্দুবাসিনী সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের একদল ছাত্রের তত্ত্বাবধানে কার্যক্রমটি শুরু হয়। স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেদের হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে ছিন্নমূল শিশুদের জন্য লেখাপড়ার সামগ্রীর যোগান দিতো। কাজের সাথে সাথে প্রয়োজনে কাজের ক্ষেত্র যেমন বাড়তে থাকে তেমনি কোন এক মধুর আকর্ষণে বাড়তে থাকে সদস্য সংখ্যাও।
বর্তমানে এই সংস্থাটির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫০০ জনেরও বেশি, যারা সারাদেশে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে শুধু শিশুদের জন্যই কিন্তু নয়, বরং সকল স্তরের ছিন্নমূল মানুষদের জন্য। শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা দায়িত্ব নিয়ে থাকেন অসহায় মানুষদের কর্মসংস্থানের। পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে অসহায় মানুষের কাছে প্রতিদিন ইফতার পৌঁছে দেওয়ার গুরুভারও বহন করে চলেছে এই সংস্থা, প্রায় নয় বছর ধরে!
ঈদ মানে খুশি, আনন্দ। আর এই আনন্দকে সবার মাঝে সমান ভাবে ছড়িয়ে দিতে ঈদ বাজার ও নতুন পোশাক বিতরণের আয়োজন থাকে প্রতিবছর। এই সংস্থার সব থেকে বড় আয়োজন শিশুতোষ চলচ্চিত্র উৎসব 'বায়োস্কোপ', যেখানে শিশুদের ধারণকৃত আলোকচিত্রের প্রদর্শনী হয়। এমনকি দেশি-বিদেশি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে শিশুতোষ চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে সংস্থাটি। শিশুদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে আয়োজিত হয় 'ছবি আঁকার উৎসব' আর অনলাইন ভিত্তিক 'প্রতিভা অন্বেষণ উৎসব'। ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হল মধুমাসে ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে করা 'ফল উৎসব'। গ্রীষ্মে বৈশাখের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে ' ছিন্নমূল শিশুদের পান্তা ইলিশ উৎসব' ও করে থাকেন এই সংস্থার সদস্যরা।
নিজেদের কার্যক্রমকে এখানেই সীমাবদ্ধ রাখেনি সংস্থাটি৷ জরুরী প্রয়োজনে মুমূর্ষু রোগীদের রক্তের যোগান দিতে 'শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন' গড়ে তুলেছে 'ব্লাড ডোনার গ্রুপ'। সেবা দানের তালিকায় সারাবছরের নানা দুর্যোগকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনে চলমান থাকে বিভিন্ন কার্যক্রম। শীতে শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি, বর্ষায় বন্যাদুর্গত এলাকায় 'ত্রাণ বিতরণ'।
শুধু উৎসব কিংবা দুস্থদের ত্রাণ বিতরণই নয়, শিশুদের মনন ও মেধা বিকাশে এই ফাউন্ডেশনটি নিয়মিত প্রকাশ করে থাকে শিশুতোষ পত্রিকা 'শিশু কিশোর বার্তা'।
শিশুহত্যা, শিশু ধর্ষণ রোধে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন কর্মসূচি, দরিদ্র কৃষকের ধান কেটে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া, দুস্থ পরিবারের বিবাহযোগ্যা কন্যার বিয়ের আয়োজন, বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানায় খাবারের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট সংখ্যক দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য মাসিক উপবৃত্তির ব্যবস্থা, রাস্তার প্রাণীদের জন্য 'স্ট্রে এনিমেল ওয়েলফেয়ার প্রোজেক্ট' সহ নানা কর্মে মানবতার পথে নিজেদের স্বাক্ষর রেখে চলেছে 'শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন'।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সময়ের আতঙ্কের নাম কোভিড-১৯। শুধু স্বাস্থ্যখাত নয়, এই মহামারী নাড়িয়ে দিয়েছে দেশের আর্থসামাজিক ভিত্তিকেও। তাই নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকলেও থেমে থাকেন নি একজন স্বেচ্ছাসেবকও। করোনার এই মহামারীর সময়ে প্রায় দেড় হাজার পরিবারের বাজার করে দেয়া, দেশব্যাপী মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণের কাজ করা হয়েছে এই সংস্থা থেকে। এমনকি যাকাতের টাকায় স্বাবলম্বী প্রোজেক্টের অধীনে ছাগল, সেলাই মেশিন ও হাঁসের বাচ্চা কিনে দেয়ার মত কাজগুলোও তারা করেছেন পূর্ণ উদ্যোমে।
দাঁড়িয়েছেন অসহায় অসংখ্য নারীর পাশে। শুধুমাত্র খাদ্যের মত মৌলিক চাহিদাই নয়, বরং নারীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে লকডাউনের বদ্ধ সময়ে ফাউন্ডেশনটি নিজ অর্থায়নে নারীদের হাতে তুলে দিয়েছে স্যানিটারি ন্যাপকিন।
তবু এখনো পথ বাকি আরো অনেকটুকু। স্বপ্নের পথের তো কোন সীমা পরিসীমা হয় না। তাই 'শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন' এখনো স্বপ্ন দেখে একদিন শহরের বুকে অসহায় মানুষদের জন্য গড়ে তুলবে হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম। সারাদেশে ছড়িয়ে দেবে 'স্বপ্নপুরী স্কুল' এর শাখা।পরিকল্পনার তালিকায় আছে একটি শিশুতোষ টিভি চ্যানেল সৃষ্টি করা, যেখানে শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করা হবে। শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশনের নিজস্ব প্রকাশনী সৃষ্টি করে দেশের সর্বস্তরের শিশু কিশোরদের জন্য একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা যেখানে তারা তাদের মনের ইচ্ছা মত সকল লেখা ছড়িয়ে দিতে পারবে। দেশে নতুন করে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের সংস্কৃতি গড়ে তোলারও স্বপ্ন দেখে সংস্থাটি, যেখানে শিশুরা এসে নিজেদের থেকে হাতে কলমে শেখার সুযোগ পাবে। তাদের ইচ্ছে আছে – একদিন শিশুদের আলোকচিত্রের উৎসব পৌঁছে যাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
স্বাবলম্বী প্রোজেক্টের আওতায় আরো শত শত মানুষকে নিয়ে আসবে একদিন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলাও তাদের অন্যতম লক্ষ্য। যার মাধ্যমে এই শিশুরাই একদিন পাশে দাঁড়াবে আরো শত শত অসহায় ছিন্নমূল মানুষের। 'শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন'কে আজকের শিশুরাই একদিন নিয়ে বিশ্ব সকলের দুয়ারে।