কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের জন্মদিন আজ
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক। মাত্র ৭টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি যে অসামান্য খ্যাতি কুড়িয়েছেন, তা অবিশ্বাস্যই বলা যায়। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনদের সঙ্গে একই কাতারে তার নাম উচ্চারিত হয়। তিনি ছিলেন যুগ সচেতন চলচ্চিত্রকার, গল্পকার, নাট্যকার এবং অভিনেতা।
জানা যায়, ঋত্বিক সিনেমা নির্মাণ করতেন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। নিজের বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছানোর। কখনও খ্যাতি কিংবা পুরস্কারের কাছে মাথা নত করেননি। কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটিই ছিলো তার কাছে প্রধান। তাইতো মাত্র ৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা তৈরি করেই এখনও চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কাছে এক বিস্ময়ের নাম। আজ এই কিংবদন্তির ৯৬ তম জন্মবার্ষিকী।
তিনি ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার ২, হৃষীকেশ দাশ রোডের ঝুলন বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন যমজ ভাই-বোন। তাঁর বোন প্রতীতি দেবীরও জন্ম হয়েছিল একই সাথে। পিতা সুরেশ চন্দ্র ঘটক তখন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মাতা ইন্দুবালা দেবী ছিলেন রাজশাহীর মেয়ে। তার শৈশবের পুরোটাই কেটেছে রাজশাহীর পদ্মা নদীর কোলে। তার ভাই লোকেশ ঘটক ছিলেন ভারতের নৌবাহিনীর কর্মকর্তা, ছবি আঁকতেন এবং ছবি তুলতেন। তিনি ঋত্বিকের চলচ্চিত্র স্রষ্টা হওয়ার পেছনের অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণাদাতা ছিলেন।
ঋত্বিক ঘটকের কিশোর ও যুবা বয়সের অনেকটা সময় কেটেছে রাজশাহী শহরের মিয়াপাড়ায় নির্মিত বাড়িতে। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করেন। কবিতা লেখা দিয়ে শুরু। তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তখনই তাঁর লেখা কবিতা ‘দেশ পত্রিকায়’ ছাপা হয়। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে আই.এ পাশ করেন তিনি।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তার পরিবারের সঙ্গে তিনি ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় চলে যান। তবে জন্মভূমি ত্যাগ করে শরণার্থী হওয়ার মর্মবেদনা ঋত্বিক কোনোদিন ভুলতে পারেননি। আমৃত্যু এই যন্ত্রণা বয়ে বেরিয়েছেন। এই বেদনারই ছাপ পড়েছে তার সৃষ্টিতে। এই সময়টাতেই কলকাতায় ভারতীয় নাট্য সংঘ আইপিটিএ তে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতিতে দীক্ষা নেন- কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই তে যোগদান করেন।
১৯৪৮ সালে ঋত্বিক তার প্রথম নাটক ‘কালো সায়র’ লেখেন। ১৯৫১ সালে যোগ দেন ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনে (আইপিপিএ)। তার লেখা শেষ নাটক ‘জ্বালা’ লেখেন এবং পরিচালনা করেন ১৯৫৭ সালে। ক্ষণজন্মা এই পুরুষ একাধারে লিখতেন, পরিচালনা করতেন এবং অভিনয়ও করতেন।
তার তৈরি প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫২ সালে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটি অন্যতম প্রধান একটি চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে মঞ্চ, সাহিত্য ও প্রামাণ্যচিত্র্যের সংমিশ্রণ প্রবাদতুল্য। তার প্রথম বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’ মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। হাস্য-রসাত্মক গল্পে ঘটেছে সায়েন্স ফিকশনের মেলবন্ধন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটি এমন এক অভিনব ছবি যেখানে একটি গাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এর গল্প।
১৯৬৬ সালে কিছুদিনের জন্য পুনায় গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে শিক্ষকতা করেছিলেন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়ায়। ১৯৭০-এর দশকে আবার ফিরে আসেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। সেসময় বাংলাদেশি প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান অর্থ লগ্নি করেন ঋত্বিকের বিখ্যাত ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর জন্য। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। তার শেষ চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪) তারই আত্মজীবনী।
১৯৪০ দশকে তৎকালীন পূর্ববাংলা থেকে দলে দলে উদ্বাস্তু কলকাতার দিকে যাচ্ছিলেন। তেমনি এক অবস্থায় পরিবারের সঙ্গে ঋত্বিক ঢাকা ছাড়েন। তাই তার চলচ্চিত্রগুলোয় উদ্বাস্তু-জীবনের বিভিন্ন দিক লক্ষ্য করা যায়।
ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত শেষ চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এটি মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। এই চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটকের ব্যক্তি জীবনের অনেক কিছুই উঠে এসেছে। কারণ এটা তার আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। দেশভাগ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল বাড়ি আন্দোলন এই সব কিছু তিনি তুলে ধরেন এখানে।
ঋত্বিক ঘটক নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো হলো- ১৯৫২ সালে ‘নাগরিক’, ১৯৫৮ সালে ‘অযান্ত্রিক’, ১৯৫৯ সালে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ১৯৬০-এ ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ১৯৬১-তে ‘কোমল গান্ধার’, ১৯৬২-তে ‘সুবর্ণরেখা’, ১৯৭৩-এ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এবং ১৯৭৪ সালে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এছাড়া একাধিক শর্ট ফ্লিম ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৭০ সালেই তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়। একই বছর তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসেবে ঋত্বিক ঘটক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে রজত কমল পুরস্কার অর্জন করেন।
অনেক স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি অসম্পন্ন রেখে ঋত্বিক কলকাতায় মারা যান ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, মাত্র ৫০ বছর বয়সে। উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতে তার নির্মাণ সারাজীবন বেঁচে থাকবে।