করোনা কি আমাদের শুধরে দেবে!
বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে আরো ৩ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। একই সময়ে ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৮ জন। এ নিয়ে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৩০ এবং আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮২ জনে। ওয়ার্ল্ড মিটার-এর তথ্য অনুযায়ী এই মুহূর্তের বিশ্ব পরিস্থিতি হচ্ছে ২০৮টি দেশ ও অঞ্চল করোনা আক্রান্ত, আক্রান্তের সংখ্যা ১৬,৯৬,১৩৯ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১,০২,৬৬৯ আর সুস্থ হবার ৩,৮২,০৫৩ সংখ্যা। আর প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে এই পরিসংখ্যান।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের যে বিশ্লেষণ তাতে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন মহামারীর দিকে। আগামী ত্রিশ দিন আমাদের জন্য খুব কঠিন সময়। হয়ত বাড়বে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা। বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোতে ইতোমধ্যেই করোনা মহামারী রূপে দেখা দিয়েছে, মৃত্যু হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষের। আর প্রাণের এই ক্ষয় চলমান আছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তেরিও গুতেরেস বলেছেন- ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংকটে বিশ্ব’ । করোনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। করোনা প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে। বাঁচবার করুণ প্রচেষ্টায় নানা রকম পরামর্শ, কবিরাজী, টোটকা ঔষধ, পরামর্শ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। বলা যায়, মানুষের দিনযাপন আর চিন্তার পুরোটাই দখল করে নিয়েছে করোনা।
করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে এখন শুরু হয়েছে সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন , আইসোলেশন। চোখ ধাঁধানো বিপনিবিতান, সুপারমার্কেট, সুপারস্টল, রেস্টুরেন্ট, ক্যাসিনো আর প্রমোদকেন্দ্রগুলো এখন বন্ধ, লক্ষ লক্ষ গাড়ি গ্যারেজ বন্দী, মানুষ ঘর বন্দী, বিমানগুলো বন্দী হ্যাংগারে। পৃথিবীর রূপ এখন ভিন্ন। মানুষ ঘর বন্দী, কিন্তু পাখিরা কলতান করছে গাছে গাছে, সাগরে খেলা করছে ডলফিন, বিরল প্রজাতির নীল গাই হাঁটছে রাজপথ ধরে। সাগরের পানি হয়ে গেছে নীল। বাতাসে আকাশ ঢেকে দেয়া কালো ধোঁয়া নেই, আকাশ স্বচ্ছ আর নীল, বৃক্ষগুলো আরো সবুজ।
প্রকৃতিতে কমে গেছে দূষণ। ব্রিটিশ ভিত্তিক থিংকট্যাংক কার্বন ব্রিফের এক গবেষণায় বলা হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীনে গত দুই মাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ২৫ শতাংশ কমে গেছে। সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে বায়ুদূষণ কমে গেছে। বিশ্বব্যাপী ভূ-প্রকৃতি ফিরে পেতে শুরু করেছে আপন প্রাণ।
বিজ্ঞান বলে, ‘প্রতিটি বিষয় বা ঘটনার পেছনে রয়েছে কিছু কার্যকারণ এবং সেখান থেকে আমরা কিছু ফলাফল লাভ করি’। বিজ্ঞানী নিউটনের মতে, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’। জীবনঘাতী করোনা যেমন বিপন্ন করে দিয়েছে আমাদের জীবন তেমনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। করোনা আমাদের কি বুঝিয়ে দিলো এ নিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিলগেটস ১৪টি পয়েন্ট দিয়ে চমৎকার কিছু শিক্ষণীয় কথা বলেছেন। যার মোদ্দা কথা হচ্ছে, এই ভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে ধনী-দরিদ্র সবাই সমান, আমরা বিলাসী আর ভোগবাদী সমাজ গড়েছি, আমাদের ক্ষমতার দম্ভ খুব ঠুনকো, আমরা ঘরের মানুষকে সময় দেইনি, প্রকৃতিকে অনেক বেশি ধ্বংস করে ফেলেছি ইত্যাদি এবং সবশেষে তিনি একটা চমৎকার কথা বলেছেন- এটাকে গ্রেট ডিজাস্টার হিসেবে না দেখে গ্রেট কারেক্টার হিসেবেই দেখতে চাই।
গত কয়েক শতাব্দী ধরেই চলেছে মানুষের অগ্রযাত্রা । মানুষ কি করেনি? অবিশ্বাস্য ভাবে বদলে দিয়েছে পৃথিবী। সমুদ্রের তলদেশে যেমন টানেল করেছে, তেমনি মঙ্গলগ্রহেও রেখেছে তার পদছাপ। বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে শ্বাসরুদ্ধকর দ্রুততায়। তথ্যপ্রযুক্তি পৃথিবীকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয় যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহান সেই ১৯৬৪ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারেরও আগেই বলেছিলেন গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্ব গ্রামের কথা। সেই গ্লোবাল ভিলেজেই এখন বাস করছি আমরা। এখন আমরা এমন এক সময় ও পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে জীবন উপভোগ্য, আনন্দময় এবং নানা জটিল রোগকে আয়ত্তে এনে দীর্ঘায়ু। আবার অসম ও অশুভ প্রতিযোগিতার, অমানবিকভাবে বাণিজ্যিক এবং অন্তঃসারশূন্য। জীবন সম্ভাবনাময় আশা সৃষ্টিকারী,আবার অতৃপ্ত ও সংঘাত সৃষ্টিকারী। বিশ্ব মেতে উঠেছে ক্ষমতার লড়াইয়ে। মারণাস্ত্র তৈরি, পেশী শক্তির প্রদর্শন, মানবতা বিধ্বংসী খেলা আর ক্ষমতার দম্ভে বিশ্ব এখন এক অন্ধ দানব। পিঁপড়া মারার মতো মারছে মানুষ, পিঁপড়ার মতো মরছে মানুষ। মানুষ নিজেই ধ্বংস করেছে নিজের সভ্যতা। ১৯১৪ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯১৮ পর্যন্ত চার বছর স্থায়ী প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে দুই কোটি মানুষ নিহত হয়। ১৯৩৯ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৫ সাল ছয় বছর পর্যন্ত স্থায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে পাঁচ কোটি হতে সাড়ে আট কোটি মানুষ মারা যায়। এই দুটো যুদ্ধই প্রমাণ করে ক্ষমতার দম্ভ, লড়াই, হিংস্রতা কতটা ভয়ংকর হতে পারে!
আমাদের এ অগ্রযাত্রায় আমরা থাবা বসিয়েছি সবখানে। আমাদের লোভী হাত, দখলদারি চরিত্র সবকিছু দখল করে নিয়েছে। আমরা গ্রাস করেছি প্রকৃতি, নিশ্চিহ্ন অসংখ্য জীব আর প্রাণ। এই পৃথিবী যে শুধু আমার একার না, বৃক্ষ, লতাগুল্ম, আরো আরো প্রাণের, সেটা আমরা শুধু ভুলেই যাইনি, বরং সব কিছু ধ্বংস করে হেসেছি বিজয়ের পৈচাশিক হাসি।
এখন পুরো বিশ্ব মোকাবেলা করছে জীবনঘাতি করোনা ভাইরাস। আমাদের অগ্রযাত্রার দম্ভ আর ক্ষমতার আস্ফালনকে গুড়িয়ে দিয়েছে এই ভাইরাস। প্রমাণ করে দিয়েছে বিশ্ব বিধাতার কাছে আমরা ক্ষুদ্র একটা বালুকণার মতো। অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, ধর্মের কথাও বলেছেন অনেকেই। করোনা কি কোনো ধর্ম, জাতি গোষ্ঠী বা শ্রেণি মেনেছে? এমন কোনো ধর্মের বা জাতির লোক কি আছেন যাকে এই জীবাণু আক্রমণ করেনি? করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছে ধর্মের এতো বিভেদ, এতো হানাহানি; এগুলোও মূল্যহীন পৃথিবীর গভীর সংকটের কাছে। জাতিগত অহংকার, ‘আমরাই শ্রেষ্ঠ’ এই ধারনা ভিত্তিহীন, অসার। পৃথিবী যখন সংকটাপন্ন হবে, যখন পৃথিবীকে আমরা সংকটাপন্ন করে তুলবো তখন সে সংকট কারো একার জন্য হবে না। সমগ্র মানব জাতির ওপরেই তা সমভাবে নেমে আসবে। মাশুল দিতে হবে সবাইকে। কেউ পার পাবেনা ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী বা শ্রেণির দোহাই দিয়ে। তাই মানুষকে তুমি যতোই বিভক্ত করো ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী, বিত্তে আর ক্ষমতার নিক্তিতে, আসলে তুমি বিপন্ন, তোমার জীবন খুব অনিশ্চিত।
আমরা বুঝতে পারছি করোনা শুধু এই পৃথিবীকে কাঁপিয়েই দেয়নি আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা নিয়ে এসেছে। পৃথিবী যেভাবে ছুটছে, যেভাবে আমরা ছুটছি বল্গাহীন, এটাই জীবন নয়। জীবনের জন্য প্রয়োজন ধ্যান, প্রয়োজন বিরতির। আমাদের বেপরোয়া লোভ আর কামনার লাগাম টানা প্রয়োজন। আপনজন আর নিজেকে কিছুটা সময় দেয়া প্রয়োজন।
যে কোনো ফ্লাইট দুঘণ্টা বিলম্ব হলেই আমাদের সব রুটিন এলোমেলো হয়ে যায়। একদিন বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ থাকলেই আমরা পাগল হয়ে যাই। আজ থেকে মাত্র পাঁচ মাস আগে পৃথিবীর যে বাস্তবতা ছিলো, তখন যদি বলা হোত একটি দেশের সব ফ্লাইট, সব অফিস, সব শহর বন্ধ করে দাও। তাহলে তাকে কি বলা হোত, বলা হোত বদ্ধ উন্মাদ।
কিন্তু আজ বিশ্বটাই বন্ধ। একটা জীবাণু থামিয়ে দিয়েছে পৃথিবীকে। এই এত উন্নতি, এত এত বিজ্ঞানও কাজে লাগেনি। এক অলৌকিক ইশারায় যেন থেমে গেছে সব। এই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তিনি যে এক মুহূর্তে পাল্টে দিতে পারেন সব, সেটাই বুঝিয়ে দিলেন লৌকিক সমাজকে।
আর তারপর এই যে বুঝলাম, ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, মানুষের জীবন অনিশ্চিত, জাতি, ধর্ম, শ্রেণি কিছুই নয়; মানুষ সবই এক। প্রকৃতির প্রতি আমাদের অনাচার শোধ করতে হবে কড়ায় গণ্ডায়। এখন কি শিক্ষা নেবো আমরা?
বিল গেটসের কথাতেই ফিরি, ‘এটাকে গ্রেট ডিজাস্টার হিসেবে না দেখে গ্রেট কারেক্টার হিসেবেই দেখতে চাই’। সত্যি কি করোনা ‘কারেক্টার’হবে? আমাদের শুধরে ফেলবে? কিভাবে শোধরাবো আমরা? কালই খবর দেখেছি ত্রাণের চাল আত্মসাৎ করে মেম্বার পলাতক। আমরা এখনও ত্রাণ চুরি করছি, নিশ্চয়ই আরো অনেকেই ছক কেটে ফেলেছি এই দুর্যোগ মহামারিতে কিভাবে আরো বাণিজ্য করা যাবে, কিভাবে আরো চুরি করে পকেট ভরা যাবে। বিশ্ব মোড়লরাও নিশ্চয় ছক কাটছেন এই মহামারীকে কাজে লাগিয়ে আরো নিখুঁত কূট কৌশলে মানুষকে জিম্মি করে বাণিজ্য বৃদ্ধির।
আমরা দেখবো, বুঝবো, কিন্তু শিক্ষা নেবো না। কারণ আমরা মানবজাতি। ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। হয়ত আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আমরা জানি, এই করোনাকাল এক সময় থাকবে না। মানুষের অদম্য ও অপরিমেয় প্রচেষ্টা আবিষ্কার করে ফেলবে করোনার প্রতিশেধক। আমরা চাই পৃথিবী করোনামুক্ত হোক, হাসুক মানুষ, জয় হোক মানবতার। আর সত্যি চাই মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিক। আর পুনরাবৃত্তি না ঘটুক ইতিহাসের।
লেখক: নূর কামরুন নাহার
লেখক ও কবি।