গণপরিবহনে নারীদের হয়রানি বন্ধের উপায় কী
কয়েকযুগ পেছনে যদি তাকাই, তখন নারীদের চার দেয়ালের মধ্যে থেকে হরহামেশা বের হওয়ার ক্ষমতা খুব একটা ছিলোনা। বর্তমানে সমাজ অনেকটা এগিয়েছে। নারীরাও ইচ্ছেমতে সকল ক্ষেত্রে নিজের প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছেন। সকল ক্ষেত্রেই বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ আর সেই সাথে যেনো পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হয়রানি। আর আজকাল বোধহয় নারীদের সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয় গণপরিবহনে। গণপরিবহন স্বস্তি নয় বরং আতঙ্ক তৈরি করছে নারীদের মনে।
রাত ৮টা। সাভার থেকে বাস চলছে ঢাকার দিকে। আমিনবাজারের আগে পাম্প এলাকায় খালি জায়গায় একজন বোরকা পরিহিত তরুণী বাস থামাতে হাত দিয়ে ইশারা দেন। এদিকে বাসের প্রত্যেকটি সিটেই যাত্রী রয়েছে। নারীদের জন্য বরাদ্দ সিটেও পুরুষরা বসে আছেন। হাতের ইশারা পেয়ে ড্রাইভার বাস থামাতে চাইলেও সামনে থাকা কয়েকজন মধ্যবয়সী পুরুষ যাত্রী বলে উঠলেন, ‘ওই বেটা, পুরুষরাইতো যেতে পারছি না, মেয়ে মানুষ উঠাস, বসতে দিবি কই?’ ড্রাইভার বলছেন, ‘আরে ভাই এত রাতে মহিলাটা যাইবো কই, নিয়া যাই। ইঞ্জিনের ওপরের সিটেই বসামু একটু কষ্ট কইরা।’
এদিকে, আরেক দিন রাজধানীর শ্যামলিতে মিরপুর রোডে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে গণপরিবহনের একটি বাস শাহবাগ হয়ে গুলিস্তানের দিকে যাবে। বাসে সিটের তুলনায় যাত্রী বেশি। এই বাসেও নারী যাত্রীদের জন্য বরাদ্দ সিটে পুরুষরা বসে আছেন। নারীরা বাসে উঠলেও তাদের বসতে দেওয়া হচ্ছে না। একজন নারী প্রতিবাদ করলে তাকে পাত্তা না দিয়ে বসেই আছেন পুরুষ যাত্রীরা। কিছু দূর যেতেই কলেজগেট স্টপেজে দুজন নারী হাত ইশারা দিয়ে বাস থামাতে বললেও সামনের পুরুষ যাত্রীরা একই কথা বলছেন, ‘ওই হেলপার নারীদের উঠাইস না, আমরা পুরুষরাই তো যেতে পারছি না। ওই ড্রাইভার গাড়ি টান সামনে।’ বাসের মধ্যে কয়েকজন বলে উঠছেন, ‘আরে ভাই নারীদের না নিলে তারা অফিসে যাইবো কেমনে? নিয়ে যান।’
এ বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন নারী যাত্রীর সঙ্গে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা নারীরা কী মানুষ না? আমরাও তো অফিস করি। না নিলে সময়মতো অফিসে না যেতে পারলে আমাদেরও তো সেলারি কাটে। আর সরকার আমাদের নারীদের জন্য প্রতিটি গণপরিবহনে সিট বরাদ্দ রেখেছে, সেখানে কেন পুরুষরা বসেন? আমরা ৬/৯ সিট চাই না। সমান অধিকার চাই। আমাদের জন্য বাসের অর্ধেক সিট বরাদ্দ রাখতে হবে। পুরুষরা দাঁড়িয়ে যেতে পারলে আমরা কেন পারবো না? আমাদের নারীরা এখন কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। গণপরিবহনে সমান সিট চাই।’
নারী যাত্রীরা অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘সিট সমস্যাই শেষ নয়, অনেক সময় পুরুষের সঙ্গে পাশাপাশি বসতে গেলেও যৌনহয়রানির শিকার হতে হয়। আমরা মেয়েরা যখন জানালার কাছে বসি, অনেক সময় পুরুষ যাত্রীরা আমাদের ঠেলতে ঠেলতে বাসের সাইটে আটকে ধরে। সরাসরি হাত দিয়ে আমাদের স্পর্ষ না করলেও হাতের কুনুই দিয়ে বাজেভাবে চেপে ধরে। বারবার তাদের হাত সরাতে বললেও এমন ভাব ধরেন, মনে হয় তারা কিছু জানেন না। বেশি প্রতিবাদ করলে একটু স্যরি বলে পার পেয়ে যান। কিছু বলতে পারি না লোকলজ্জার ভয়ে। কারণ, প্রতিদিন আমাদের প্রয়োজনে গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়।’
শান্তা আক্তার (ছদ্ম নাম) ঢাকায় বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। প্রতিদিন তাকে গণপরিবহনে ফার্মগেট দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। মাঝেমধ্যেই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে পড়েছেন তিনি। তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে অফিস টাইমে বাসে করে অফিসে যাই। এই সময়ে গণপরিবহনে ভিড় থাকে বেশি। বসা যাত্রী ছাড়াও সিটের পাশে দাঁড়িয়ে যান অনেকে। সমস্যা হচ্ছে আমি যেদিন সিটে বসে যাই পুরুষ যাত্রীরা অনেক সময় পাশে এসে শরীরে সঙ্গে ঘেঁষে দাঁড়ান। তারা আমার দিকে ফিরে দাঁড়ানোতে তাদের বিশেষ অঙ্গ দিয়ে চেপেও ধরেন অনেক সময়। লজ্জায় সরেও দাঁড়াতে বলতে পারি না। অনেক সময় প্রতিবাদ করি। তবে, চুপ থাকি বেশি।’
আঁখি (ছদ্ম নাম) পড়াশোনা করেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটু দূরে শহরেই। প্রতিদিন পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, ‘গাড়িতে ওঠার সময় হেল্পাররা হাতে-পীঠে ধরে তারপর ওঠান। এটা বিরক্তিকর। এরপর নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা সিটে প্রায়দিনই বসতে পারি না। উঠে দেখি পুরুষরা বসে আছে। বললেও ওঠে না। পরে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অনেক সময় ভিড়ে পড়লে বাসের মধ্যে পুরুষরা ইগনোর করে কথা বলেন, কেন উঠলাম ভিড়ে। এমন তো হবেই।
আঁখি আরও বলেন, ‘গণপরিবহনে আমাদের সিটে আমরা বসবো। নারীরা বাসে না থাকলেও যেন নারীর সিট ফাঁকা থাকে, এটা নিশ্চিত করতে হবে। নারীরা এখন অনেক এগিয়ে, তারা এখন ৬/৯ সিটে সীমাবদ্ধ নেই। বরাদ্দ সিটের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।’
মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ি রোডে চলাচলকারী বাসের হেল্পার স্বপন বলেন, ‘নারী যাত্রীদের গায়ে আমরা হাত সহজে দেই না। তারা যাতে গাড়িতে ওঠার সময় পড়ে না যান, এজন্য ধরে ওঠাই। বেশির ভাগ হেল্পারের কোনো শিক্ষা-দীক্ষা নেই। তাদের প্রশিক্ষণ দিলে কোনো যাত্রীর সঙ্গেই এমন খারাপ কিছু করবে না।’
ঢাকার উত্তরা-আজিমপুর রোডে যাতায়াতকারী বাসের ড্রাইভার আতাউর বলেন, ‘আমাদের বাসে নারীদের জন্য বরাদ্দ করা সিট রয়েছে।অনেক সময় জোর করে পুরুষরা বসে পড়ে। তবে, নারীরা আসলে উঠাই দেই। অনেক সময় পুরুষ যাত্রীদের সঙ্গে ঝগড়া হয় এনিয়ে। আবার বাসে যাত্রী বেশি থাকলে নারীরা সিগনাল দিলেও ওঠাতে পারি না। কারণ, বাসের অনেক পুরুষ যাত্রীরা বলেন, ওই বেটা নারীদের উঠাইয়া বসাবি কই? আমরাও যেতে পারি না। আমরা কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না। এদিক-সেদিক হলে আমাদেরই মাইরধইর করে।’
জাহাঙ্গীর হোসেন, আলিফ পরিবহনের একজন বাস মালিক। তার গাড়ি মিরপুর থেকে বনশ্রী রোডে চলাচল করে। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ড্রাইভার বা হেল্পারদের নিয়োগ দেই, তাদের বলে দেই, তোমাদেরও মা-বোন আছে। নারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে না। তাদের সিটে তাদের বসতে দেবে। কোনো অনিয়মের অভিযোগ পেলে তাদের সেভাবেই আমি ব্যবস্থা করি।’
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি গণপরিবহনে যাত্রীর নিরাপত্তার কথা। যেই বাসে ভালো দরজাটাই নেই, সেখানে অপরাধ কমাবেন কী করে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি গণপরিবহনে যাত্রীর নিরাপত্তার কথা। যেই বাসে ভালো দরজাটাই নেই, সেখানে অপরাধ কমাবেন কী করে। আমাদের দেশে আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই। আইনের শাসন বাস্তবায়ন জরুরি। স্টপেজ ছাড়া বাস থামানো যাবে না। বাসের দরজা সবসময় বন্ধ রাখতে হবে। এই সেক্টরের মালিক-শ্রমিকরা আমাদের সুপারিশগুলো মানছেন না। মানতে হবে, সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যায়ের পর শাস্তি না হলেই অপরাধ বাড়ে।’
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘গণপরিবহনে নারীরা কোনোভাবেই নিরাপদ নেই। আমরা দেখি, অভিযোগ পাই, নারীরা পুরুষের পাশাপাশি বসলে বিভিন্ন ভাবে স্পর্ষ করা চেষ্টা করেন, ধাক্কা দেন, ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকান, সব মিলিয়ে আচরণগুলোই এক ধরনের যৌন-হয়রানিমূলক।’
পারিবারিক শিক্ষার কথা তুলে ধরে নাজমা বলেন, ‘আলাদা সিটে বসার মাধ্যমে, সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেই নারীদের যৌনহয়রানি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। আগে প্রয়োজন জনসচেতনতা। পারিবারিক শিক্ষা। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। যৌনহয়রানির জন্য নারীকে দোষারোপ করা যাবে না, বরং হয়রানিকারীকে আইনের আওতায় আনতে হবে। যৌনহয়রানি করলে কী শাস্তি আছে, সেটা প্রচার করতে হবে।’
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘গণপরিবহনে নারীদের যৌনহরানি বন্ধে আমরা সবসময় কাজ করে যাচ্ছি। বিশেষ করে দূরপাল্লার অনেক গাড়িতে সিসি ক্যামেরা বসিয়েছি। ঢাকা সিটির গণপরিবহনেও বসানোর জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। নারী-পুরুষের জন্য সিট আলাদা করা হয়েছে। পুরুষ যাত্রীরা তা মানছেন না। যাত্রীর তুলনায় গণপরিবহন কম, তাই দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না। তবে, আইন হলে করা যাবে। যাত্রী ওঠানোর সময় গাড়ি থামিয়ে উঠাতে হবে, এটা বলা আছে। এখন প্রশাসনিক নজরদারি বাড়ালে এগুলো কার্যকর হওয়া সম্ভব।’