তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় আর পাব না
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
আর পাব না না না না, আর পাব না।
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব ছেড়ে দিব না
তোমায় বক্ষ মাঝে রাখবো ছেড়ে দিব না।
সারাজীবন হৃদয়ের অন্তস্তলে জায়গা নিয়ে থাকেন এমন কিছু রচয়িতা এই পৃথিবীতে ভক্তদের মাঝে জায়গা করে নিয়েছেন অনেক আগে থেকেই। যাঁরা পৃথিবীতে না থাকলেও পৃথিবীর মানুষের হৃদয়ে সবসময়ই থাকেন।
এমনই এক রচয়িতা এই বাংলাতেই জন্মেছিলেন। তাঁকে হয়তো চোখে দেখতে পারি নি কিন্তু জন্মের পর থেকে তাঁর রচিত অনেক ছড়া, গান, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক-এর সাথে পরিচিত আছি। এরকম একজন ব্যক্তি এই বাংলায় জন্ম নিয়েছেন, যিনি মৃত্যুর হাজার বছর পরেও সকলের হৃদয়ে থাকবেন। তিনি আর কেউ নন আমাদের সকলের প্রিয় কবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদাসুন্দরী দেবীর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। ভাই-বোনদের মধ্যে তার অবস্থান ১৪ তম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, দার্শনিক, ছোটগল্পকার, চিত্রকর, অভিনেতা ও কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। তাঁর ছদ্মনাম ছিল ভানুসিংহ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মনে করা হয় বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী সাহিত্যিক। তিনি কবিগুরু, বিশ্বকবি প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩ টি উপন্যাস, ৩৬ টি প্রবন্ধ, ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮ টি নাটক, ৯৫ টি ছোটগল্প এবং ১৯১৫ টি গান রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ছোটগল্প ও গান গুলো যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া তাঁর যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা প্রকাশিত হয়েছে ৩২ খণ্ডে 'রবীন্দ্র রচনাবলী' নামে। তাঁর রচনা গুলো বাংলার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষাতেও অনুদিত হয়েছিল। তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গীতাঞ্জলি, রবীন্দ্র রচনাবলী, গোরা, ঘরে বাইরে, আমার সোনার বাংলা, জন গন মন প্রভৃতি। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন এবং ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-তে তার রচিত প্রথম লেখা 'অভিলাষ' প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র সতেরো বছর বয়সে ১৮৭৮ সালে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন। ১৮৮৩ সালে তাঁর বিয়ে হয় মৃণালিনী দেবীর সাথে। তিনি ১৮৯০ সাল থেকে পূর্ব বঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০২ সালে তাঁর পত্নী বিয়োগ হলে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
ব্রিটিশ সরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ১৯১৫ সালে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করেন, কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য শ্রীনিকেতন নামক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে 'বিশ্বভারতী' প্রতিষ্ঠিত করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। তিনি তাঁর রচনার মাধ্যমে মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, দেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, বাস্তবচেতনা, প্রগতিচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য সকলের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করতেন। গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার প্রতি মতামত দেওয়া ছাড়াও সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মতামত পেষণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই এক ব্যক্তি যিনি তিন দেশের বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত এর রচয়িতা। ২২ শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে কলকাতার জোড়াসাঁকোর পৈত্রিক বাড়িতেই মৃত্যু বরণ করেন এই অভূতপূর্ব রচয়িতা। আজ তাঁর ৮০ তম প্রয়াণ দিবস কিন্তু আজও তিনি একইভাবে বিরাজ করে যাচ্ছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে।
সারাবিশ্বের প্রতিটি মানুষের মনে রয়েছেন শ্রেষ্ঠ রচয়িতারূপে। তাঁকে দেখতে পায় নি, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট রচনা পড়েছে এমন পাঠকের হৃদয়ে তিনি সারাজীবন বেঁচে থাকবেন। কবিগুরুর প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।