Skip to content

২৫শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৯ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইতিহাসের গোপন রত্ন: সুলতানা রাজিয়া ও ভারতবর্ষ

ভারতবর্ষের ইতিহাসে দিল্লি সালতানাত এবং মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি ১২০৫ থেকে শুরু করে ১৮৫৭ পর্যন্ত৷ এই দীর্ঘ সময়ে ভারতবর্ষের শাসনভার একজন নারীর হাতে ন্যস্ত হয়েছিলো। অবশ্য নামটা অনেকেরই অজানা নয়। সুলতানা রাজিয়া ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক। অবশ্যই বংশধরের অভাবে তিনি শাসনভার গ্রহণ করেন কিন্তু তার পরিণতি খুব সুখকর ছিল তা বলা যাবেনা। 

 

সেসময় দিল্লি সালতানাত এ বন্দেগান-ই-চেহেলগান বা চল্লিশ দাসের দাপট দেখার মতো। এই বন্দেগান-ই-চেহেলগানের একজন ইলতুৎমিশ মৃত্যুর আগে তাঁর কন্যা সুলতানা রাজিয়াকে শাসনভার গ্রহণের জন্যে মনোনীত করে যান। অবশ্যই একে স্নেহের আতিশয্য বলে রায় দেয়া সম্ভব না। ইলতুৎমিশ যথেষ্ট বিচক্ষণ এবং স্থিতধী শাসক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। বরং একথা আমরা বলতে পারি সুলতানা রাজিয়ার মধ্যে সেই গুণগুলোর সমাহার ঘটেছিল যা ইলতুৎমিশ সহজেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ইলতুৎমিশের আরো কিছু পুত্র ছিল কিন্তু তারা রাজ্য শাসন করার যোগ্য মোটেও ছিলেন না। 

 

ইতিহাসের গোপন রত্ন: সুলতানা রাজিয়া ও ভারতবর্ষ

 

তবে তখনো মুহাম্মদ ঘুরীর নির্বাচিত বন্দেগান ই চেহেলগান এর দাপট ফেলনা নয়৷ তারা কোনোমতেই একজন নারীর শাসন মেনে নিতে পারেনা। একে তো তাকে সুলতান বলে ডাকা সম্ভব না। ডাকতে হবে সুলতানা। এর মানে হল সম্রাটের স্ত্রী। কিন্তু ইনি তো আর সম্রাটের স্ত্রী নন। তাই তারা শাসনে বসালেন সুলতানা রাজিয়ার সৎ ভাই রোকনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে। ফিরোজ আবার আমোদপ্রিয়, অলস এবং লম্পট প্রকৃতির মানুষ ছিলেন৷ তার আড়ালে তার মা বরং শাসনকাজে হস্তক্ষেপ করতেন। একসময় বন্দেগান ই চেহেলগানের সদস্যরাও কোপিত হয়ে ওঠে। রাজ্যের মানুষরাও সুলতানের উপর অসন্তুষ্ট। ব্যাস, রোকনউদ্দিন ফিরোজ এবং তার মাকে হত্যা করা হল। সুলতানা রাজিয়া এই সুযোগের মাধ্যমেই আবার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন। আপাতত চল্লিশ দাস এই শাসন মেনে নিলো কিন্তু পদে পদে বাধা সৃষ্টি করতে শুরু করে। 

 

ফলাফল যা হওয়ার তাই, সুলতানা রাজিয়ার পতন একসময় ঘটে। তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে রয়েছে অসংখ্য গুজব। বিষয়টি স্বাভাবিক কারণ যেহেতু তিনি ছিলেন একজন নারী শাসক তাই তাঁর সব ইতিহাস বা ঘটনাকেই অতিরঞ্জিত করা হয়েছিল৷ এমনকি তাঁর শাসনকালেও অসংখ্য গুজব ছড়িয়েছে। আর এই গুজবগুলো শাখা-প্রশাখা মেলেছে কারণ তিনি নারী ছিলেন। 

 

ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করাটা এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য না। ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক কেমন ছিলেন? মূলত ছোটবেলা থেকেই রাষ্ট্রনীতি আর যুদ্ধের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল দেখার মতো। তিনি এসকল নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে হেরেমের পরিবেশের সাথে তাঁর পরিচয় ছিলনা। তিনি ছিলেন মার্জিত, শিক্ষিত এবং বিচক্ষণ। কূটনৈতিক চালগুলো ভালোভাবেই অনুধাবন করতে এবং রাজ্যের অন্দরমহলের প্রতিযোগিতা সম্পর্কে একজন নারী হয়েও ছিলেন পূর্ণ সচেতন।

 

ইতিহাসের গোপন রত্ন: সুলতানা রাজিয়া ও ভারতবর্ষ

 

এমনকি শাসনভার গ্রহণের পরেও তিনি মূলত নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্যে পুরুষোচিত পোশাক পরিধান করতেন। এমনকি বেশ কিছু বিদ্রোহ তিনি কঠোর হাতে দমন করেছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দিল্লি সালতানাতের সিংহাসনে অনেকেই বসেছেন। এদিকে সুলতানা রাজিয়ার শাসনকাল মোটে চার বছর। ইতিহাসের পাতায় এর গুরুত্ব আহামরি কিছু নয়। কিন্তু সুলতানা রাজিয়া তাঁর নেতৃত্ববলে এই চারটি বছরকে করে তুলেছিলেন অর্থবহ।

 

রাষ্ট্র পরিচালনার সকল দক্ষতা তাঁর ছিল। এমনকি তিনি কোরআন পাঠ করতে পারতেন এবং ধর্মকর্মের দিক থেকেও আদর্শ ছিলেন। তবে এটুকুই মূলত উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। মূলত চল্লিশ দাস বা বন্দেগান ই চেহেলগানের কর্তৃত্বই সুলতানা রাজিয়ার নির্মম পরিণতির জন্যে দায়ী। রাজিয়া সুলতানা ধর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ উদারতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। শাসনকর্মের ক্ষেত্রে তিনি যোগ্যদেরই প্রাধান্য। স্থানীয় যোগ্য অনেক লোককেই তিনি প্রশাসনে কাজ দিয়েছেন। শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন এবং বহু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অবশ্য অধিকাংশই আমরা বাস্তবায়িত হতে দেখিনি শুধুমাত্র অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্যে। 

 

সমরবিদ্যা এবং রাষ্ট্রবিদ্যায় তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন আচরণ সত্যিই অবাক করার মত। সেই সময়ে তিনি নিজে একজন খ্যাতিমান যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তিনি নিজে বেশ সফল শাসনকাল চালিয়ে গেছেন। এতকিছুর পরেও শুধুমাত্র নারী বলেই তাকে কেউ গ্রহণ করতে পারেনি। ধর্মের দোহাই দিয়ে তিনি নারীত্বকেই যে খাটো করা হয়েছে তা নয়, তাঁর মেধাকেও অপমান করা হয়েছে। 

 

তবে সুলতানা রাজিয়া এখনো একটা প্রেরণার নাম হয়ে উঠতে পারে। সেই ৮০০ বছর আগে এবং সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই সময়ে কোন নারী শাসনকার্যে বসবে এই কথাটা ভাবতে গেলেও বুকে কাঁপুনি ধরে৷ তবে সুলতানা রাজিয়ার ইতিহাস নিয়ে যেমন লেখা হয়নি উপন্যাস তেমনি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও আমরা পাইনা। হয়ত একটা সময়ে ইতিহাসের কোণ থেকে কেউ আবিষ্কার করবে কোন একটি রত্ন। সুলতানা রাজিয়া এখনো নারীদের বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যেতে পারে। বিশেষত সেসকল অনন্যাদের, যারা নেতৃত্বের প্রতিভা নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছে এবং সময় এই নেতৃত্বকে গ্রহণ করবে সহজেই। 

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ