এডিথ ক্যাভেল: একজন সাহসী নারী নার্সের গল্প
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশপ্রেম ও মানবতার আর্তির পাশাপাশি মানবতা ও শান্তির কথাও ঘুরেফিরে আসছিল। সাহসের মাঝেও মাধুর্য থাকতে হয়। এডিথ ক্যাভেল রেড ক্রসের একজন সাহসী সেবিকা, শুধু সাহসের কারণেই ৪৯ বছর বয়সে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি হন তিনি। হ্যাঁ, ৪৯ বছর বয়সে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি হয়ে তিনি কি ভেবেছিলেন, তা কিন্তু জানা নেই। তবে হয়তো সেই সাহস শুধু দেশপ্রেমের বাণীই বহন করেনি। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথা আমাদের সবারই জানা। কিন্তু এডিথ ক্যাভেলের কথাই বা কজন জানে? অথচ ইতিহাসে এডিথ ক্যাভেলের গল্প শুধু মানবতার অনন্য নজির, তা নয়। বরং এক বীভৎস সময়ে থেকেও সাহস বুকে রেখে এগিয়ে চলার গল্প সেটি।
আমি বুঝতে পেরেছিলাম, দেশপ্রেমই যথেষ্ট না। বরং অন্য কারো প্রতিই কোনো ঘৃণা বা বিরক্তিভাব পুষে রাখা যাবে না।
– এডিথ ক্যাভেল
এডিথের জন্ম ১৮৬৫ সালের ৪ ডিসেম্বর সোয়াদারস্টন গ্রামে। নরউইচের নিকটস্থ এই গ্রামে এডিথের বাবা প্রায় ৪৫ বছর ধরে ভাইসারের পদ গ্রহণ করে রেখেছিলেন। এডিথের বাবা রেভারেন্ড ফ্রেডরিক ক্যাভেল এবং মা লুইসা সোফিয়া ওয়ার্মিং। এডিথের আরো দুই বোন এবং এক ভাই ছিল। ভাই-বোনের মাঝে এডিথই সবার বড়।
প্রথমে নরওয়িচের একটি স্কুলে লেখাপড়া করলেও পরে বোর্ডিং স্কুলে লেখাপড়া করতে হয়। তাই বাড়ি থেকে কিছুটা দূরত্ব তখন ছিল। ১৮৯০-৯৫ সময়ে বাবার অসুস্থতার খবর শুনে এডিথ বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে ফিরে বাবার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। বাবাকে সেবা-শুশ্রূষা করার সময় এডিথ নার্স হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। ১৮৯৬ সালে ৩০ বছর বয়সে লন্ডন হাসপাতালে নার্স প্রবেশনার হিসেবে যোগ দেন। এরপর বিভিন্ন হাসপাতালে এডিথ কাজ করেছেন। অনেকটা ভ্রাম্যমাণ নার্সের মতোই তিনি কাজ করতেন।
এডিথ সেবার ক্ষেত্রে কখনই বাছবিচার করতেন না। বিশেষত, ১৮৯৭ সালে মেইডস্টনে টাইফয়েডের মড়কে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। সেখানে তিনি কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মেইডস্টন পদক পান। এরপর এডিথের আরো অনেক জায়গায় সেবাকার্যের সাক্ষ্য আছে।
কিন্তু এডিথের জীবনের সব চেয়ে বড় সাক্ষ্যের মঞ্চ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা শুরু হয়েছে। এডিথ নরফোকে মায়ের সাথে দেখা করতে গেছে। যুদ্ধের সময় জার্মান অধিকৃত বেলজিয়ামের খবর পাওয়া গেল। সেখানে মিত্রবাহিনীর অনেক সৈন্যই আটকে আছে। এডিথের মনে হলো, ক্রমশ ধেয়ে আসা জার্মান সেনাদের থেকে এই আহত সৈন্যদের রক্ষা করা তার দায়িত্ব।
এডিথ রেড ক্রস হাসপাতালে নার্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে যেকোনো সৈন্যদেরই সেবা করা রেড ক্রসের দায়িত্ব। মনের যুদ্ধের পর একবার এডিথকে জার্মান লাইনে আটকে থাকা দুই ব্রিটিশ সৈন্যকে সেবা করার অনুরোধ করা হয়। এডিথ কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই ওই সৈন্যদের সেবা করেন। এমনকি বেলজিয়াম থেকে নিরপেক্ষদের নেদারল্যান্ডে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। এ-ভাবেই পরবর্তী ১১ মাসে এডিথ অন্তত ২০০ ব্রিটিশ সৈনিককে পালাতে সাহায্য করেন।
বিষয়টি মোটেও সামান্য কিছু না। হাসপাতালে মিত্রবাহিনীর লোকদের সেবা করা। সৈন্যদের পথ দেখিয়ে পালাতে সাহায্য করবে, এমন গাইড খুঁজে বের করা মোটেও সহজ কিছু না। গোপনে সব কিছু পরিচালনা করতে গেলে নিজের দেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়।
১৯১৫ সালের ৫ আগস্ট, এডিথ ধরা পড়ে যান। গুরুতর এই অপরাধের জন্যে এডিথকে সেন্ট গিলস কারাগারে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়। এবার বিচারকার্য শুরু হয়। এডিথ মোটেও ভয় পাননি। স্বদেশপ্রেমই যথেষ্ট না, তা এত দিনে বুঝে গেছেন। তার বক্তব্য স্পষ্ট, ‘কিভাবে থামব আমি, যখন আমার চারপাশে এত মানুষ আহত?’
কিন্তু দেশের আইনের জন্য বিষয়টি কোনো মতেই সঠিক না। এরই মাঝে এডিথের সাথের ৩৪ জনকেও আটক করা হয়। এবার কোর্ট মার্শাল। বিচারে এডিথকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
১৯১৫ সালের ১২ অক্টোবর ন্যাশনাল ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয় এডিথকে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এই মৃত্যুদণ্ড অবৈধ কিছুই ছিল না। কিন্তু অন্যান্য নিরপেক্ষ দেশ, বিশেষত লন্ডনের মানুষ এই বিচারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিশেষত রিক্রুটমেন্ট পোস্টারে এডিথের স্মৃতিচারণা করা শুরু হয়। এমনকি ব্রিটেনে মিত্রবাহিনীর জন্য এডিথ একজন প্রতীক হয়ে ওঠেন।
যুদ্ধে-পরবর্তীতে এডিথের মরদেহ আবার ব্রিটেনে নিয়ে আসা হয়। নরউইকে তাঁকে ফের যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে সমাহিত করা হয়। কিন্তু এডিথের কাজ তাঁর মৃত্যুর পরবর্তীকালীন মর্যাদার না। বরং যুদ্ধের সময়, প্রচণ্ড স্নায়ুযুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার গল্প। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের মাঝামাঝি আহত সৈন্যদের প্রতি কোনো ঘৃণা না রেখেই এডিথ ক্যাভেল কাজ করেছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে এমন সাহসিকতা দেখানোর জন্য অনেক নারী নার্সের পেশায় আসার উৎসাহ পেয়েছে। এমনকি আধুনিক সময়েও সাহসিকতার একজন প্রতীক হিসেবে তিনি সমাদৃত।
অনন্যা/এআই