যৌতুকের বলি নারী: হোক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
গ্রাম-অঞ্চলে একটি প্রবাদ বিশেষভাবে প্রচলিত, ‘এক গাছের ছাল অন্য গাছে জোড়া লাগে না’। কথাটির বিশ্লেষণ করলে মূলত এটাই দাঁড়ায়, নারীরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সবকিছু ছেড়ে স্বামীর ঘরে প্রবেশ করে। জন্মলগ্ন থেকে যেই পিতা-মাতা তাদের মেয়েকে খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করে তুললেন, সেই মেয়েকেই সবরকম সূতো কেটে অন্য পরিবারের সঙ্গে বন্ধন গড়ে তুলতে হয়। আর সে কাজটি কখনোই একদিনের নয়৷ অনেক সাধনা, শ্রম দিয়ে নারীরা অন্য একটি পরিবারের সঙ্গে নিজের বন্ধন সৃষ্টি করে। মায়ার বাঁধনে জড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলে। তবু এই নারীদের অনেকেই সত্যিকার অর্থেই কোনোদিনই শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সদস্য হয়ে উঠতে পারে না!
জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে যে নারী অচেনা-অজেনা একটি জগতে প্রবেশ করে, সেই জগতে শত চেষ্টার পরও তারা থাকে অস্পৃশ্য। পান থেকে চুল খসলেই নারীকে কঠোর সুরে জানানো হয় সে বাইরের কেউ। এতটাই অবজ্ঞা করা হয় মাঝে মধ্যে; যার ফলে নারীদের মনে হতে থাকে খুব দয়া করে মনে হয় তার স্বামী-শ্বশুর বাড়ির লোকজন এ পরিবারে তাকে স্থান দিয়েছেন। তার এ জায়গায় আসার মতো কোনো যোগ্যতাই নেই। এই চিরন্তন অবহেলার শিকার নারীরা যখন কারও পরিবারের অংশই হয়ে উঠতে পারে না শত চেষ্টায়ও। তাহলে নারীর প্রাপ্তি কী?
বলা চলে নারীর প্রাপ্তি গুম, খুন, ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য শারীরিক, মানসিক নির্যার্তন, স্বামীর অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার ফলে অবজ্ঞা, অবহেলা, বঞ্ছনা-লাঞ্ছনার শিকার হওয়া। এমন অসংখ্য সমস্যা-ঘটনা নারীর সঙ্গে জড়িত। এই নারীরা যখন পিতৃগৃহ ত্যাগ করে নতুন একটি জগতে প্রবেশ করে, তখন শত আশায় বুক বাঁধে। অসংখ্য স্বপ্নের বীজ তৈরি হতে থাকে মনে। কিন্তু সঠিক যত্ন, লালন-পালনের অভাবে বীজের অঙ্কুরোদগমও ঘটে না। নারীরা তাদের সুপ্ত বাসনা লুপ্ত রেখেই জীবন পার করে দেওয়ার হিসাব কষতে থাকে। কিন্তু সেই হিসাবের খাতায়ও মাঝে মাঝে ফল শূন্য হয়ে যায়।
নারীকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করা হয়, নারীকে খুন করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, ধর্ষণের শিকারে পরিণত করা হয়, অর্থ জোগানের অন্যতম বাহক করে তোলা হয়, সব সমস্যার জটিলতায় এই নারী বা স্ত্রীর, সেটাও পুরুষের চক্ষু এড়ায় না। ফলে নারী মানেই বহু সমস্যা, বহু ঘটনার সমাহার পুরুষের মস্তিষ্কে। আর তাকে তাই শাসন এবং সর্বোচ্চ শোষণে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলা হয়। বর্তমান সময়ে অহরহ নারীকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা। কিছুদিন পর হয়তো এই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাদের আগের মতো দিব্যি জীবনযাপন করতে শুরু করে কিন্তু খসে যায় একটি প্রাণ! নারীকে এমন অবমাননা, এভাবে হত্যা করার পর এরাই আবার নারীকে বশে আনতে অন্য ফাঁদ পাতে।
সম্প্রতি ঘটে চলা একটি ঘটনা লক্ষ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। গণমাধ্যমে এসেছে, নোয়াখালীর সেনবাগে পুলিশ এক গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় নিহতের বাবা আত্মহত্যায় প্ররোচনার লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন নিহতের স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও দেবরের বিরুদ্ধে। নিহত গৃহবধূ নাসরিন আক্তার(১৯) উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের ৪নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম ছাতারপাইয়া গ্রামের মো. জহিরের স্ত্রী।
গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, প্রায় তিন বছর আগে সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের পশ্চিম ছাতারপাইয়া গ্রামের আবুল কালামের ছেলে অটোরিকশা চালক মো. জহিরের সঙ্গে বিয়ে হয় নাসরিন আক্তারের। বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন সময় যৌতুকের দাবিতে তার ওপর নির্যাতন করে আসছিল তার স্বামী জহির। এছাড়া নিহতের শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর তুচ্ছ ঘটনায় নাসরিনকে প্রায় মানসিক নির্যাতন ও মারধর করত। এই ঘটনার ভুক্তভোগী শুধু নাসরিন আক্তার একা নন। বাংলাদেশে অসংখ্য নারী এরূপ অসহনীয় সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে জীবনযাপন করে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কেউ হঠাৎ নাসরিনের মতো লাশে পরিণত হয়। এবং একইসঙ্গে স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতটাই অত্যাচারের সীমা পার করে ফেলে যে, মৃত্যু নিশ্চিত করেও নারীর রক্ষা মেলে না। নারী থাকে তাদের অস্পৃশ্য!
নারীর প্রতি এরূপ অবহেলা, বঞ্চনার প্রতিকারে নারীকে সহনীয় পর্যায় পর্যন্ত থাকা উচিত নয়। এর কারণ এই যে, তার ফল নাসরিনের মতো লাশে পরিণত হওয়া। মনে রাখতে হবে, অপরাধীকে যত বাড়তে দেওয়া যায় তারা ঠিক ততটাই ডানা গজিয়ে, শেকড়বাকড় নিয়ে এঁটে বসতে চেষ্টা করে। অত্যাচারিত মনোভাব যার মগজে সেই মানুষকে যতটা সুযোগ দিয়ে শুধরাতে চেষ্টা করা হোক না কেনম, আদতে তারা কতটা বদলায়!
নারী হত্যা, আত্মহত্যার মতো ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে একটা বিষয় অন্তত স্পষ্ট হয়, অত্যাচারী কখনও তার মাত্রা কমায় না। বরং সে পথ পরিবর্তন করে ফলে নারীদের এখনও সচেতন হতে হবে। নাসরিনের মতো অসময়ে লাশে পরিণত হওয়া চায় নাকি জীবনকে ভালোবাসা চায়। তাই নারীকে বুঝতে হবে জীবন মূল্যবান। হেলায় হারিয়ে দেওয়া যাবে না একমুহূর্ত, একটি ক্ষণ! ফলে নারীদের প্রতি অত্যাচার হলেই আওয়াজ তুলতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। জেগে উঠুক নারী। সমাজের মস্তিষ্ক থেকে অন্ধত্ব দূর করুক।