সিঙ্গেল নারীকে বাসাভাড়া দিতে আপত্তি কেন!
আমাদের সমাজে আজও কিছু কিছু বিষয়ে মানুষের বেশ গোঁয়ার্তুমি লক্ষ করা যায়। যেমন : সিঙ্গেল নারীকে বাসা ভাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে নানাবিধ ঝামেলা পোহাতে হয় ওই। বাড়িওয়ালাদের নানাবিধ বিধিনিষেধ, প্রশ্নের মুখে নারীটিকে গুটিৈ থাকতে হয়। ভয়ে – ভয়ে চলতে হয় সারাক্ষণ। শুধু তাই নয় কোনো নারী যদি খুব কষ্টে একটি বাড়ি ভাড়া জুটাতেও পারেন তবে, আশেপাশের মানুষের সার্বক্ষণিক শকুনি দৃষ্টির কাছে নারীটিকে খুব বিব্রত বোধ করতে হয়। কিন্তু সিঙ্গেল নারীকে বাসা ভাড়া দেওয়া বা সিঙ্গেল নারীর প্রতি এত তদরকি কেন? আমাদের সমাজ কবে পরিবর্তন হবে!
যুগের পরিবর্তনে নারীরা এগিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। কিন্তু সমাজ প্রতিনিয়ত সমস্যার জাল সৃষ্টি করছে। নারীরা নিজেদের এগিয়ে নিতে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পড়াশোনা, চাকরিতে বিশেষভাবে ঝুঁকছেন। স্বাবলম্বীতা অর্জন করার জন্য তাদের মধ্যে একধরনের বাসনা সৃষ্টি হয়েছে। পূর্বে নারীরা সংসার-সন্তানকে শতভাগ গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু বর্তমান নারীরা কিছু সময় হলেও নিজের জন্য রাখছেন। কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও নিজের সম্পর্কে ভাবতে- বুঝতে শুরু করেছেন, ফলে ঘরে বন্দি থেকে সমস্যার যে ধরণ ছিল এখন তার চিত্রটা পাল্টেছে।
নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে তার কারণ সামাজিকভাবে নারীকে নানারকম নিপীড়ন, অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে এযুগে এসেও। ফলে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে। সেইসঙ্গে অনেক নারী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষমও বটে। তবে নারীদের জীবন কোনদিন সহজ ছিল না। এখনও নয়। বরং যুগের সঙ্গে সঙ্গে ধরণ পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু নিপীড়ন, অত্যাচার, শোষণের মাত্রা আজও কমেনি।
প্রতিনিয়ত নারীরা সমাজ এবং পারিবার সৃষ্ট নানাধরনের মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এই চাপের মুখে যুক্ত হয়েছে নতুনতর সমস্যা। পড়াশোনা বা চাকরিজনিত কারণে বহু নারীকে শহরে থেকে জীবন পরিচালনা করতে হচ্ছে। যেহেতু কাজের জায়গা বা পড়াশোনার জায়গা ভিন্ন ফলে পরিবারের সঙ্গে থাকা অনেকের পক্ষেই সম্ভব না। আবার এমনও দেখা যায় একই শহরে হলেও নারীর কর্মক্ষেত্র বা স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা দূরে। সেক্ষেত্রেও যাতায়াতের অপ্রতুল পরিস্থিতি, সময় সাপেক্ষ হওয়ায় নারীরা পরিবারের সঙ্গে না থেকে বাইরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে চান। নারীদের জন্য হল, হোস্টেলে বরাদ্দকৃত সিট সবসময় নির্দিষ্ট। ফলে একজনের পক্ষে নানারকম সমস্যাই দেখা দিতে পারে। আবার বর্তমানে বেশিরভাগ নারীই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছেন। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগেরই নিজের বেড়ে ওঠা এলাকার বাইরে গিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে, বসবাস করতে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। নারীকে সঠিকভাবে গড়ে উঠতে প্রয়োজন সঠিক পরিবেশ। সেক্ষেত্রে অনেকেই মহিলা হোস্টেল, মেস, সাবলেট বাসা, বা পুরো বাসা নিয়েই নিজের মতো করে থাকতে চান। এক্ষেত্রে বিষয়টা শুধু নারী শিক্ষার্থীদের জন্যই নয় বরং কর্মজীবী নারীদের জন্যও। যারা সিঙ্গেল নারী, কিন্তু কর্মজীবী।
এমনও বহু নারী আছেন যারা চাকরিজনিত কারণে একা থাকতে বাধ্য হন। আবার কেউ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ফলে নারীদের জন্য সুন্দর, মনোরম, সিকিউরিটি সম্পন্ন বাসায় নারীরা থাকতে ইচ্ছে পোষণ করেন। কিন্তু নারীর ইচ্ছে হলেই যে সেটা তিনি সহজেই মেটাতে পারছেন বিষয়টা এমন নয়। একজন সিঙ্গেল পুরুষ বা নারী উভয়ের জন্যই বাসা ভাড়া পাওয়া যথেষ্ট কষ্টের। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ সমস্যায় পড়তে হলে সেখানে নারীর ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় মহামারী সমস্যা। শহরেরে কোন বাড়িওয়ালাই সিঙ্গেল নারীকে বাসা ভাড়া দিতে চান না কোনভাবেই। সেখানে যুক্ত হয় নানারকম প্রশ্নের। এমনকি অনেকটা অপমানের। কিন্তু সিঙ্গেল নারীর বাসাভাড়ায় আপত্তি কেন?
সামাজিকভাবে কিছু প্রথার সৃষ্টি হয়ে গেছে। ফলে শহরাঞ্চলে সিঙ্গেল নারীকে বাসা ভাড়া নিতে হলে তোপের মুখে পড়তে হয়। বাড়িওয়ালা শুনতেই নারাজ থাকেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। অনেকেই বিষয়টা খুব আপত্তিকর মনেও করেন। কিন্তু একজন সিঙ্গেল নারীকে বাসাভাড়া দেওয়ার বিষয়ে বাড়িওয়ালা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন এটা স্বাভাবিক। কিন্তু নারীদের বাসাভাড়া না দিলে তারা কোথায় যাবে? তাদেরও কাজের সূত্রে, পড়াশোনার সূত্রে একা জীবনযাপন করতে হয়। সেক্ষেত্রে নারীকে এমন উদ্ভট প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলা বা সন্দেহপরায়ণ হয়ে নানারকম মন্তব্য করা একেবারেই উচিত নয়। কারণ যুগ পাল্টেছে। তাই বর্তমান বাড়িওয়ালাদেরও উচিত চিন্তাধারা পাল্টানো। নারী হন বা পুরুষ তিনি সিঙ্গেল থাকতেই পারেন। কাজের ধরণ ভিন্ন হতেই পারে কিন্তু অসংখ্য নারী-পুরুষ একাই থাকতে বাধ্য হন। ফলে সময়ের সঙ্গে চিন্তাধারার পরিবর্তন করা উচিত।
নারী বা পুরুষ যেই হন না কেন সময় বদলেছে। ফলে জীবন পরিচালনার ধরণও বদলেছে। সেক্ষেত্রে কর্মজীবী নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরাও আলাদাভাবে বাসা নিয়ে থাকছে। কিন্তু নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা প্রথায় আঘাত লাগতেই পারে কিন্তু সম্পূর্ণটাই মানসিকতার ব্যাপার। তাই প্রথমেই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। তারপর যিনি বা যারা বাসা ভাড়া দিচ্ছেন তারা তাদের সেফটির জন্য সতর্কতা অবলম্বন করবেন। এক্ষেত্রে যাকে ভাড়া দিচ্ছেন তার ডিটেইলস পরিচয়, সিসি ক্যামেরা, গেটম্যান রেখে নানাভাবে বাসাটা সিকিউর রাখতেই পারেন। তাতে করে যতটা সুবিধা বাড়ির কর্তার তারচেয়ে বরং সুবিধা বেশি নারীটিরই। কারণ তিনি একটি সুস্থ পরিবেশ পাবেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বর্তমান যুগে এসেও নারীদের বাসা ভাড়া না দিতে চাওয়াটা অমানবিক এবং মানসিক নির্যাতনের সামিল। ফলে মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে শিখতে হবে। নারীর জন্য সুস্থ সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই আমাদের নারীরা নির্দ্বিধায় আরও এগিয়ে যেতে পারবে। আধুনিক যুগে এসেও আমরা বর্বর আচরণে বিশ্বাসী। নতুবা একজন মানুষের স্বাধীন জীবনযাপন, চলাচলে এত কৌতুহল কেন? আর কেনোই বা এসব সমস্যার সৃষ্টি হবে? নারীর প্রতি এ ধরনের আচরণ পরিবর্তনের জন্য সামাজিক আন্দোলন বাড়াতে হবে। নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে।