স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ: মানবিকতা কোথায়
নারীর প্রতি অত্যাচার আমাদের সমাজে নতুন নয়। বর্তমান সমাজে এতোটা অবক্ষয় বেড়েছে যে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ যতো আধুনিক ও ডিজিটাল হচ্ছে ততোই খসে পড়ছে। মানুষের এই অমানবিকতা প্রাণে শিহরণ জাগায়। কোথায় আছি আমরা? যে সমাজ নারীকে সম্মান করে না, নারীর প্রতি চড়াও হয় তাদের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী আশা করবে! তদুপরি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সত্যি ভাবিত করে।
গণমাধ্যম বরাত জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মীর মশাররফ হোসেন হলে বহিরাগত স্বামীকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের এক নেতা ও বহিরাগত এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। শনিবার (০৩ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত সাড়ে ৯ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল সংলগ্ন বনাঞ্চলে ধর্ষণের এ ঘটনা ঘটে।
ধর্ষণে অভিযুক্তরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও বহিরাগত যুবক মামুন (৪৫)। মোস্তাফিজ মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী। ভুক্তভোগী জাহিদ সাভারের জিরানি এলাকার ভবানীপুর বটতলায় থাকেন। তার ডেকোরেটর ব্যবসা আছে। তার স্ত্রী একটি বিউটি পার্লার পরিচালনা করেন।
ভুক্তভোগী জানান, ওই দম্পতির বাড়িতে ভাড়া থাকতেন অভিযুক্ত মামুন। পূর্ব পরিচয়ের ভিত্তিতে শনিবার সন্ধ্যায় ভুক্তভোগীর স্বামীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে আসেন তিনি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসলে তাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে আটকে রাখেন অভিযুক্তরা। এরপর তার স্ত্রীকে দিয়ে নিজের রেখে আসা জিনিসপত্র আনতে বলেন মামুন। তার প্রেক্ষিতে মামুনের জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন ভুক্তভোগী নারী। পরে জিনিসপত্র নিয়ে মামুন হলের ভিতরের ওই কক্ষে রেখে আসেন। এরপর তার স্বামী অন্যদিক থেকে আসবে বলে ওই নারীকে হল সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে যান অভিযুক্তরা। পরে সেখানে তাকে ধর্ষণ করেন অভিযুক্ত মোস্তাফিজ ও মামুন।
ভুক্তভোগী ওই নারী বলেন, ‘মামুন ভাই আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতো। তিনি আমার স্বামীর মাধ্যমে ফোন দিয়ে আমাকে তার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বলেন। আমি তার জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে যাই। তারা আমাদের বাসা ছেড়ে দিয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলের মোস্তাফিজ ভাইয়ের কাছে থাকবে বলে জানায়।’
ভুক্তভোগী নারী আরও বলেন, ‘এরপর মামুন আমার কাছ থেকে তার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে হলে রেখে আসে। পরে আমার স্বামী অন্যদিকে থেকে আসবে বলে আমাকে হলের সামনে থেকে পাশের জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যায়। তার সাথে মোস্তাফিজ ভাইও ছিলো। তখন তারা আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।’
হলের অভ্যন্তরে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যায়, ভুক্তভোগী নারী রাত ১০ টা ৩৩ মিনিটে হলের সামনে এসে গার্ডদের কাছে তার স্বামীর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করছেন। পরে হল অফিসের বাইরে আরেকটি ক্যামেরায় দেখা যায়, ১০ টা ৪৫ মিনিটে তাকে দলবেঁধে মারধর করে নিয়ে যাচ্ছে মোস্তাফিজ। পেছন পেছন ওই নারীকে দৌড়ে যেতে দেখা যায়।’
হলের গার্ড দুলাল গাজী ও হেমন্ত সরকার জানান, রাত আনুমানিক ১০ টার পর এক মহিলা এসে বলে তার হাজবেন্ডকে আটকে রেখেছে৷ রুম নাম্বার বলতে পারছিল না। পরে আমরা দেখলাম যে, মোস্তাফিজ ভাই ওই লোককে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছে।’
ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হলে মোস্তাফিজকে ছাত্রলীগের সকল কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিয়েছে শাখা ছাত্রলীগ। একই সাথে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে সুপারিশ করেন নেতাকর্মীরা। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকেও তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এ ঘটনায় রাত দুইটায় মীর মশাররফ হলের সামনে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা৷ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেতৃত্বে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা৷ পরে রাত একটায় ভুক্তভোগী নারীকে নিয়ে ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে আসে সাভার থানা পুলিশ। পুলিশ আসার খবরে হলের ডাইনিংয়ের রান্নাঘরের পেছনের তালা ভেঙে পালিয়ে যান অভিযুক্ত মোস্তাফিজ। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১টা ১৭ মিনিটে মোস্তাফিজকে তালা ভেঙে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছেন ছাত্রলীগ কর্মী সাগর সিদ্দিকী (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ৪৬ ব্যাচ), সাব্বির হাসান সাগর (বোটানি ৪৭ ব্যাচ) ও হাসান (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ৪৫ ব্যাচ)। পরবর্তীতে ভোর ৬ টায় (রবিবার) অভিযুক্তকে পালাতে সহায়তাকারী তিন ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করে থানায় নিয়েছে আশুলিয়া থানা পুলিশ।
তবে অভিযুক্ত মোস্তাফিজ এখনও পলাতক রয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাব্বির আলম বলেন, ‘ঘটনা শুনেই আমি ও প্রক্টর মহোদয় চলে এসেছি। পুলিশ এসেছে, তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা নিবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাদেরকে সহযোগিতা করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ.স.ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘ঘটনা শুনেছি, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের নিয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলে এসেছি। এ ঘটনায় পুলিশ আমাদের কাছে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা চাইলে, আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। হলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। ঘটনার সাথে যারাই জড়িত থাকুক, আমরা শাস্তির ব্যবস্থা করবো।’
এ বিষয়ে সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তদন্ত আব্দুর রাসিক বলেন, ‘ভুক্তভোগী থানায় উপস্থিত হয়ে ঘটনা জানিয়েছেন। আমরা প্রাথমিক তদন্তের জন্য ঘটনাস্থলে এসেছি। অধিকতর তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নানা জল্পনা-কল্পনা ও অভিযোগের ভিতিত্তে এটাই জানা যায়, ভুক্তভোগীর বাসায় মামুন ভাড়া থাকত। ভুক্তভোগী নারীর স্বামীকে আঁটকে রেখে তার স্ত্রীকে ক্যাম্পাসে আসতে বলা হয় তারপর এমন ঘটনা ঘটে! বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী মোস্তাফিজ এবং বহিরাগত মামুন যে ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে তা অনৈতিক এবং অন্যায়।
দিনের পর দিন ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। এ থেকেই বোঝা যায় সমাজের ঘুণে ধরা চিত্র। মানুষের ব্যক্তিত্বহীন জীবন। পশুর চেয়ে যখন মানুষ বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখনই সমাজের মাঝে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বারংবার ঘটে।
আমাদের সমাজে বর্তমানে নারীকে সেই আদিম যুগের মতো ভোগ্যপণ্য মনে করা হচ্ছে। পরিবারগুলো সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে ব্যর্থ। ফলে নারীদের প্রতি সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বদলে তারা নারীদের কামনার চোখ দিয়ে দগ্ধ করছে। অবাধ ইন্টারনেটের ব্যবহারের ফলে এখন শিশু থেকে প্রবীণ সবাই এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তবে এর ইতিবাচক দিক যে নেই, তা নয়। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক সেখানেই বেশি প্রবেশ করে, যেখানে গতিরুদ্ধ হয়। এছাড়া পর্ন সাইটগুলো সহজলভ্য হওয়াতেও তরুণ সমাজ এগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। সমাজের ঘটে চলা এত অস্থিতিশীল পরিবেশ থেকে নারীরা কতটা সচেতন হয়েছে?
পুরুষতন্ত্র নারীদের দুর্বল করে দিতে, মনোবল ভেঙে দিতে, তাদের ঘরে আবদ্ধ করতেই সর্বদা নারীর প্রতি নিপীড়ন করে চলেছে। ধর্ষণের মতো ঘটনা দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের বাহুবল, শক্তিশালী ও সামর্থ্যের পরিচয় দিতে চায়। যার মাধ্যমে তাদের প্রভুরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এর নেপথ্যে রয়েছে পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। পরিবার থেকে যদি শিশুদের সমান মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে গড়ে তোলা যায়, তবে তারা নারীদের শ্রদ্ধা, সম্মান করতে বাধ্য। কিন্তু বাবা-মা পরিবার-পরিজনদের কাছে বারবারই ছেলে শিশুরা মেয়েদের গণ্ডির বিষয়টা উপলব্ধি করে। ফলে শৈশবেই তার মধ্যে এক ধরনের বৈষম্যমূলক মনোভাব তৈরি হয়।
আমাদের সমাজব্যবস্থা প্রতিনিয়ত নারীকেই দোষারোপ করে। নারীর প্রতি কুদৃষ্টি এ সমাজে কম নয়। তারা নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করে, নারীকে ধর্ষণ করে, অসম্মান করে। নারীর প্রতি এমন বৈরী আচরণের কবে পরিবর্তন হবে? কবে নারী তার আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে! নারীর প্রতি এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ এবং সঠিক বিচার হওয়া এখন সময়ের দাবি। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। বিবেকহীন সমাজকে নাড়াতে হলে এর মর্মমূলে ঘা দিতে হবে। ঘটনার সত্যতা যাচাই করে অপরাধীদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।