সাকুরাগাছের দেশ থেকে এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম নারী
ছোটখাটো একজন মানুষ। মুখে সব সময় হাসি লেপ্টে আছে। দেখে কে বলতে পারবে শৃঙ্গ জয়ের মতো অসম্ভব কঠিন কাজ তিনি নিয়মিতই করতেন? পর্বতারোহীদের সব চেয়ে বড় স্বপ্ন যে এভারেস্ট, সেই এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম নারী হিসেবে প্রথম পা রাখবেন এই ছোটখাটো মানুষটি। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড’ এ তাঁর রেকর্ডের স্থানটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। হাসি-খুশি ছোটখাটো এই মানুষটি কী করে পর্বতকন্যা হয়ে উঠলেন সে-কথাই আজ জানা যাক।
১৯৩৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাপানের ফুকুশিমার মিহারু অঞ্চলে জন্ম জুনকো তাবেইর। পরিবারে সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। জুনকোর পরিবার ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি তার ভেতর কতটা প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে। খুব ছোটবেলায় জুনকোর শরীর ভীষণ দুর্বল ছিলো। তাছাড়া খুব সহজেই ভয় পেয়ে যেতেন। অভাবের সংসারে ঠিকমতো খাবার জোটানোই মুশকিল। সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আশা করাও মুশকিল। জুনকো আস্তে-ধীরে বড় হচ্ছিলেন।
জুনকোর ঘরটি ছোট্ট কাঠের ঘর। পাশে সহস্র বছরের পুরোনো এক সাকুরা গাছ। বসন্ত এলেই গোলাপি পাপড়ি দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যের অবতারণ ঘটায় এই প্রবীণ বৃক্ষ। ঘরের বাইরের কাঁচা সোনা রোদ থেকে আড়ালে রাখে কাঠের এই ছোট্ট ঘর তাকে। দুর্বল অসুস্থ জুনকোর চোখেমুখে বিষণ্ণতা সবসময় স্পষ্ট।
মিহারুতেই এক ছোট স্কুলে পড়ালেখা করতে যায় সে। পরিবারের কথা – লেখাপড়া করো নাহয় হাতের কাজ শিখো। তবে জাপানের স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের সবকিছুর স্বাদ দিতেই পছন্দ করে। একদিন স্কুলে খবর পাওয়া গেলো – দল বেধে সবাই পাহাড় ঘুরতে যাবে। তবে পরিবারের অনুমতি আগে আদায় করতে হবে। কথা তোলা কি এতই সোজা? পরিবারের সবাই তো হাসতে হাসতে খুন! এই দুর্বল মেয়ে নাকি পাহাড়ে চড়তে যাবে। যেহেতু স্কুলের ট্রিপ, তাই পরিবার তেমন বাধা দিলোনা।
জুনকোর জীবনে প্রথমবারের মতো নীরব পাহাড় দেখা। এই তাহলে পাহাড়? কোথাও সবুজের কোনো চিহ্ন নেই। তবুও পাহাড় এত সুন্দর হতে পারে? নির্জনের গায়ে হাত ঠেকিয়ে বাতাসের ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করে সে। প্রথমবারের মতো জুনকোর মুখ থেকে বিষণ্ণতার মেঘ সরে দেখা গেলো আনন্দের চাকচিক্য।
মাত্র দশ বছর বয়সে মাউন্ট নাসুতে চড়ার এই অভিজ্ঞতা তার নিয়তিকে পাহাড়ের সাথে জড়িয়ে ফেলে। নিজের পা তিনি আর থামাননি। জুনকোর এই অভিজ্ঞতা তাকে একদিন এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে দিবে একথা তখন জুনকো নিজেও কল্পনা করতে পারেননি। পরিবারের সকলকেই জানালেন, তিনি পাহাড়ে চড়বেন। কিন্তু এতদিন নাহয় হাসিঠাট্টা করা হয়েছিলো, এবার ভবিষ্যতের আশঙ্কা জুনকোর পরিবারকে পীড়িত করতে শুরু করে। এমন ব্যয়বহুল নেশাকে পরিবার ভালো চোখে দেখতেই পারছিলেন না। জুনকোকে অনেক বোঝানো হয়। কিন্তু একবার মনে কিছু জাঁকিয়ে বসলে কি আর তা হঠানো যায়?
স্কুল শেষ করে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার ইচ্ছে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। এখনই সুযোগ – পাহাড়ে চড়ার স্বপ্ন তিনি পূরণ করবেনই। অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবে দ্রুতই যোগ দিলেন। সুযোগ পেলেই পাহাড়ে চড়ে বেড়াতেন। তবে সুযোগ তো আর সহজে আসেনা। যে সময়ের কথা বলছি তখনো নারীদের পাহাড়ে চড়াটা ভালো নজরে দেখা হতোনা। আর এশিয়ার দেশগুলোতে তো নারীদের পাহাড়ে চড়া রীতিমত নিষিদ্ধ ছিলো। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব ও স্থানীয় দানব ‘ইয়োকাইদের’ ভয় তো আছেই। অনেকে তো আবার কানাঘুষো করতেন। এসব নাকি জুনকো করে ভালো বর ফাঁদে ফেলার জন্যে। মানসিক বাঁধাকে তিনি পাত্তা দিলেন না। ১৯৬২ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকালেন। তার ঠিক তিন বছর পর মাসানুবো তাবেইয়ের সাথে বিয়ের গাঁটছড়া বাঁধলেন। এই মাসানুবো নিজেও পর্বতারোহী। স্বামীর অনুপ্রেরণা থেকেই বড় মঞ্চে জুনকোর প্রবেশ।
নিজ উদ্যোগেই ১৯৬৯ সালে তিনি জাপানে প্রথমবারের মতো একটি লেডিস ক্লাইম্বিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ক্লাবটি সহজেই মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। পরের বছর ১৯ মে জুনকো তাবেই ও হিরোকো হিরাকাওয়া মিলে অন্নপূর্ণা ৩ জয় করেন। এই পর্বতারোহনের সময় তারা এক নতুন পথ আবিষ্কার করে ফেলেন। সম্ভবত এই একটি সাফল্য থেকেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ের দুরাশা করা সম্ভব হয়। কিন্তু কাজটা এতটা সহজ না। এর আগে কোনো নারীই এমনকিছু করে দেখাতে পারেনি। যারা করেছে তাদের অনেকেই ফিরে এসেছে অর্ধেক পথ পাড় করে নাহয় হারিয়ে গেছে শ্বেতশুভ্র বরফের আড়ালে।
এভারেস্ট জয় এতটা সহজ না। পরিবেশ আর সময়ের হিসেবটা চিন্তা করতে হবে। তাছাড়া প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সেজন্যে পর্বতারোহীরা স্পন্সর খুঁজে বেড়ায়। জুনকো নিজেও স্পন্সর খুঁজতে শুরু করলেন। এখানেই আসে আরেকটি বাঁধা। ধনীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে লাভ হচ্ছেনা। এমনকি নামীদামী কোম্পানিরাও আগ্রহী না। ১৯৭৫ সালে এলএলসি ১৫ সদস্যের একটি দল গড়ে ফেলেছে। কিন্তু এই নারীদের দলকে দেখে মানুষ উল্টো হাসে। কেউ কেউ তো বলেও ফেললেন, “আরে বাপু! মেয়ে মানুষ! পাহাড়ে গিয়ে কি করবে? বাড়ি যাও। ঘর সংসার সামলাও।”
যেখানে প্রতিকূলতা থাকে, সেখানে কেউ না কেউ তো এগিয়ে আসবেই। ইয়োমিউরি শিমবান নামে এক জাপানি পত্রিকা এবং নিপ্পন টেলিভিশন স্পন্সর হওয়ার কথা দিলেন। যদিও স্পন্সরের টাকাই যথেষ্ট না। এই অভিযানের প্রতিটি সদস্যকেই মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হলো।
১৫ জন নারী সদস্যের পর্বতারোহী দল। এদের মাঝে কেউ শিক্ষকতার সাথে যুক্ত, কেউ কম্পিউটার প্রোগ্রামার, এবং একজন কাউন্সেলিং করেন। এত টাকা জোগাড় করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। তাবেই পিয়ানো শেখাতে শুরু করলেন। তাতে কিছু টাকা জোগাড় হলো। অকেজো গাড়ির সিটকভার দিয়ে জলনিরোধক ব্যাগ বানানো গেলো। দস্তানাও এই গাড়ির সিট কভার দিয়েই বানানো হলো। প্রয়োজন যখন কড়া নাড়ে, মানুষ কোনো না কোনো উপায় বের করবেই। এ সময় জুনকোর দল অনেক জায়গা থেকেই সাহায্য পেলেন। শিক্ষকতার সাথে যারা জড়িত, তাদের স্কুলের বাচ্চারা বেঁচে যাওয়া জ্যামের প্যাকেট উপহার দিলো। আর স্লিপিং ব্যাগ? সেখানেও খরচ কমানো গেলো। চীন থেকে তারা হাসের পালক কিনে আনালেন। সেই পালক দিয়ে নিজেরাই সেলাই করে স্লিপিং ব্যাগ বানিয়ে নিলেন। পুরোনো পর্দা কেটে কোনোমতে বানানো হলো পরনের কাপড়। শরীর ও মনে এই হিমশীতল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন সবাই।
১৯৭৫ সালের ৪ মে, তারা যাত্রা শুরু করেলেন। ১৯৫৩ সালে এডমুন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে যে রুটে যাত্রা করেছিলেন, সেই রুট দিয়েই আবার যাত্রা শুরু করলেন তারা। সারাদিনের ক্লান্তিকর যাত্রা শেষে তারা ২১,৩২৬ ফুট উচ্চতায় হিমালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন। নিস্তব্ধতাও যেন কানে আসছেনা। হঠাৎ এক তুষারধ্বস! বরফের সমাধিই হয়তো সেখানে হয়ে যেতো। জ্ঞান ক্রমশ লোপ পেতে শুরু করছে। স্মৃতিগুলো একের পর এক মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে। মানুষের বিদ্রূপ আর খোটা শুনেও এতদূর এসেছেন। এখন এখানেই শেষ। এমন সময় উজ্জ্বল গোলাপি সাকুরার মৃদু বর্ষণের নিচে জুনকোর দুই শিশু নরিকো আর শিনয়ার ছবি ভেসে উঠলো। এখানে কোনোমতেই মরা যাবেনা। বাঁচতে হবে যেকোনোভাবেই। গলার কাছে বেঁধে রাখা এক পকেট ছুরি দিয়ে বরফ ভেদ করে বের হয়ে এলেন। বের হয়েই জ্ঞান হারালেন।
ভাগ্য সহায় – ঝুনকোর শেরপা দ্রুতই তাদের খুঁজে বের করলেন। প্রায় ছয় মিনিট বরফচাপা পড়ে ছিলেন তারা। পায়ের গোড়ালি কি মচকে গেলো? নাহ, ভয় পাওয়া যাবে না। যখন পাহাড় ভয় দেখায়, তখন পর্বতারোহীকে পর্বতের দর্পচূর্ণ করতেই হয়। শুরু করলেন এই সাহসী যাত্রা আবার। ঠিক বারো দিন কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই এভারেস্ট বেয়ে চলেছেন। তেরোতম দিনই এলো বাধা। উঁচু উঁচু শৈলশিরা যেন ভয় দেখাচ্ছে। পিছু হটবে বা অন্য পথে যাবে সে উপায়ই বা কোথায়? লোহার সাড়াশি দিয়ে কোনোমতে এগিয়ে চললেন। একটু ভুল হলেই হয় চীন বরাবর ৫০০০ মিটার নিচে চলে যাবেন নাহয় নেপারে দিকে অন্তত ৬৪০০ মিটার নিচে হারিয়ে যেতে হবে। এই সময় জুনওর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো। এই রাস্তার কথা তো কোনো অভিযাত্রীই জানায় নি। এই রাগ পুষেই সেদিন সমগ্র বিশ্বের মধ্যে এক আলোড়ন জাগালেন জুনকো তাবেই। ইতিহাসের ৩৬ তম এভারেস্ট বিজয়ী। তারচেয়ে বড় পরিচয় তার, ইতিহাসের প্রথম নারী এভারেস্ট বিজয়ী।
সারা মুখজুড়ে ভারি বরফ। তবুও ঘামে চুল লেপ্টে আছে সারা মুখাবয়বে। নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। অক্সিজেনের অভাবেই যেন সারা পৃথিবী আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তীরে এসেই কি ডুবতে হবে? তা হয়নি। এই সাফল্যের পর আর জুনকোকে মানুষের কথা শুনতে হয়নি। নেপালের রাজা এক শুভেচ্ছাবার্তা পাঠালেন। এমনকি নিজ দেশ জাপানেও সোরগোল পড়ে গেছে। সাকুরা গাছ যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছিলো জাপানে।
পরবর্তীতে তিই প্রথম নারী হিসেবে সেভেন সামিট ও জয় করেন। তবে পর্বতারোহণই কি তার একমাত্র কাজ? পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনেও নিজেকে জড়িয়েছেন। ২০০০ সালে সফলভাবে ‘অভিযাত্রী দলের বর্জ্য থেকে পরিবেশগত’ ক্ষতি নিয়ে স্নাতকোত্তর পূরণ করেন। জাপানের হিমালয় অভিযাত্রা ট্রাস্টের পরিচালনের আসনটিও সফলভাবে পরিচালনা করেন তিনি।
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে নিয়োজিত এই নারী সারাজীবন আটপৌরে জীবনযাপন করেছে। তাইতো ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর তার মৃত্যুর সংবাদ সমগ্র পৃথিবীকেই স্তম্ভিত করে দেয়। এমন উজ্জ্বল উদাহরণ কি আর খুব বেশি পর্বতারোহীর মধ্যে পাওয়া যায়?
- আফরিদা ইফরাত
অনন্যা /এআই