Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিশুদের স্কুলে অনাগ্রহের কারণ জানেন কি?

শিশুর মধ্যে স্কুলভীতি দেখা দিলে নানা ছল-ছুতোয় সে স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকে আর যদিও বা স্কুলে যায় তবে সেখান থেকে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বাসায় চলে আসে। স্কুলভীতির শিশুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা স্কুলের বদলে কেবল বাসায় থাকতেই পছন্দ করে- স্কুল পালিয়ে তারা সাধারণত অন্য কোথাও যায় না। সেই স্কুলভীতির সাতকাহন আজ জেনে নেওয়া যাক।

ছোট শিশুরা নতুন পোশাক পরে দৌড়ঝাঁপ করে স্কুলে যাচ্ছে এ দৃশ্যই তো বেশি চোখে পড়ে। তবে এর উল্টোও হতে পারে। স্কুলে যেতে আগ্রহ কম, ভীতি, কান্নাকাটি এমনও দেখা যায় শিশুদের মধ্যে। এমন হলে স্বাভাবিকভাবেই উৎকণ্ঠায় পড়ে যান অভিভাবকেরা। তবে এর সমাধানও আছে। স্কুলে যাওয়ার অনাগ্রহ শিশুরা দু’ভাবে প্রকাশ করে সরাসরি ‘না’ করে বা কান্নাকাটি করে; অথবা নানাবিধ শারীরিক উপসর্গের (যেমন: পেটব্যথা, মাথাব্যথা, বমি করা ইত্যাদি) মাধ্যমে। এসব উপসর্গ যদি স্কুল বন্ধের দিনে না থাকে এবং এর তীব্রতা যদি শুধু স্কুলে যাওয়ার আগে বা আগের রাতে; স্কুলে থাকার সময় বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে আপনার সন্তানের কোনো কারণে স্কুলের প্রতি ভীতি বা অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। এটি শিশুদের একটি উদ্বেগজনিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যা স্কুলভীতি নামে বেশি পরিচিত।

লিঙ্গ ও বয়সভেদে যেকোনো শিশুর স্কুলভীতি বা স্কুলে যেতে সমস্যা হতে পারে। সাধারণত ৭-১১ বছর বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে এ সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। যে বয়সে একটি শিশুর স্বাধীনভাবে একাকী চলাফেরা, খেলাধুলা ও বন্ধুদের সাথে মেলামশার ক্ষমতা থাকার কথা তা যদি না থাকে তখন এ সমস্যা দেখা যায়, যা ‘সেপারেশন অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার’ নামক শিশু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নামে পরিচিত।

শিশুদের স্কুলে অনাগ্রহের কারণ জানেন কি?

যে সকল শিশুর স্কুলভীতি রয়েছে তাদের দুই-তৃতীয়াংশের উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, অতি চঞ্চলতা, সামাজিক ভীতি ও মানিয়ে চলার সমস্যাসহ বিভিন্ন ধরনের শিশু মানসিক সমস্যা থাকে। এ জন্য স্কুলভীতির কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিকারের জন্য মানসিকরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু-বিশেষজ্ঞ, মনোবিদসহ অন্যান্য সহায়ক শিশু-মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সহায়তা অপরিহার্য। গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলভীতির সমস্যার সফল সমাধানে ‘স্কুলে ফিরে যাওয়ার নীতি’ গ্রহণ দুই-তৃতীয়াংশ শিশুর ক্ষেত্রে কার্যকর। এ ক্ষেত্রে পরিবার ও স্কুল-শিক্ষকের ইতিবাচক ও সহযোগী ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নীতিতে আগে থেকে সুবিধামতো দিন ঠিক করে শিশুকে কিছু পূর্বপ্রস্তুতির পর স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে স্কুল চলাকালীন বা অন্য সময় স্কুলের আশপাশে যাওয়া ও পরে স্কুলের ভেতরে প্রবেশ ইত্যাদি কৌশল বের করে।

 

স্কুলের প্রতি অনাগ্রহের কারণ-

– পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ, প্রতিদিন পরীক্ষা, খেলাধুলা বা বিনোদনের ব্যবস্থা কম থাকা ছাড়াও সামান্য ভুলে প্রচ- তিরস্কার, কঠিন শাস্তি, সবার সামনে অপমান ইত্যাদি শিশুর সংবেদনশীল মনে স্কুলের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি করতে পারে।
– অনেক শিশুর মধ্যেই সহপাঠীদের শারীরিক বা মানসিকভাবে নাজেহাল করার প্রবণতা দেখা যায়। সাধারণত বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য (যেমন: উচ্চতা, শারীরিক গঠন, কথা বলার ধরন, গায়ের রং ইত্যাদি) নিয়ে খ্যাপানো হয়ে থাকে।
– নতুন স্কুলে ভর্তি হলে- নতুন পরিবেশে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না পারলে।
– স্কুলে যাওয়া-আসার সময় কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা (যেমন: ছিনতাই, দুর্ঘটনা, বখাটেদের উৎপাত ইত্যাদি) হওয়া বা দেখা।
– নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হলে – যেমন এক মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে ভর্তি হলে।
– স্কুল ছুটির পর দীর্ঘ সময়ে অভিভাবকদের জন্য অপেক্ষাও শিশুর মনে তীব্র উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। সেটা থেকেও স্কুলভীতি তৈরি হতে পারে।
– স্কুল থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বা স্কুল গেটেই পরীক্ষা, পড়াশোনা নিয়ে তিরস্কার, অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে নেতিবাচকভাবে তুলনা ইত্যাদি স্কুলভীতির কারণ হতে পারে।
– দীর্ঘদিন কোনো কারণে স্কুলে না গেলে।
– কোনো কারণে তীব্র শোক পেলে- যেমন মা, বাবা বা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু হলে।
– স্কুলে কোনো বিশেষ সমস্যা যেমন- বাথরুমে যাওয়া নিয়ে লজ্জা পেলে।
– পারিবারিক সমস্যা হলে- মা বাবার নিত্যদিনের ঝগড়া, ডিভোর্স বা নিকটজনের যে কোনো ধরনের অসুস্থতা হলে। 
– স্কুলে প্রতিনিয়ত খারাপ ফলাফল করলে বা স্কুলে পড়ার সঙ্গে তাল মিলাতে না পারলে। 
সেপারেশন অ্যাংজাইটিতে (মা-বাবাকে ছেড়ে থাকা নিয়ে উৎকণ্ঠা) আক্রান্ত হলে।
– শিশু কোনো ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে (যেমন বিষণ্নতা, অতি চঞ্চল, অমনোযোগী শিশু, মানসিক প্রতিবন্ধী ইত্যাদি)।
– এ ছাড়া প্রিয় শিক্ষকের পরিবর্তন, নির্দিষ্ট শিক্ষকের প্রতি অহেতুক ভীতি ইত্যাদি শিশুর স্কুলভীতির কারণ হতে পারে।

শিশুদের স্কুলে অনাগ্রহের কারণ জানেন কি?

 

স্কুলের প্রতি অনীহা হলে যা করবেন-

– বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিন। স্কুলভীতির কারণে শারীরিক উপসর্গগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন। এ ক্ষেত্রে স্কুলে না যাওয়াকে প্রশ্রয় দেওয়া যেমন ভুল, তেমনি এ ক্ষেত্রে অহেতুক বকা দেওয়া, জোর করাও ঠিক নয়; বরং বাচ্চার স্কুলে অনাগ্রহের কারণ আন্তরিকভাবে তার কাছে জানতে চান। প্রয়োজনে শিক্ষকের সাহায্য নিন।

– স্কুলের মজার সময় নিয়ে কথা বলুন। স্কুল থেকে ফেরার পর প্রথমে বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা ইত্যাদি নিয়ে জিজ্ঞাসা করুন এবং বলতে দিন। প্রথমেই পরীক্ষা ও পড়াশোনা নিয়ে কথা বলবেন না।

– দৌড়ঝাঁপ করে খেলাধুলা, স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশায় উৎসাহ দিন। এগুলো ভাষার দক্ষতা, সামাজিক দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে সাহায্য করবে।

– স্কুলে যাওয়ার কয়েকমাস আগে থেকেই শিশুকে স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে মানসিকভাবে প্রস্তুক করুন। স্কুলে কী হয়, কারা থাকবে, কতক্ষণ সেখানে থাকতে হবে—এসব বিষয়ে তাকে আগে থেকে বলুন।

– যদি স্কুলে গিয়ে শিশু আপনাকে একেবারেই না ছাড়তে চায়, সে ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে নিজেকে বিচ্যুত করুন। প্রথম কিছুদিন সম্ভব হলে ক্লাসের ভেতরে থাকুন। এরপর ক্লাসের বাইরে এমন জায়গায় থাকুন, যেখান থেকে সে আপনাকে দেখতে পায়। এরপর স্কুলে থাকুন, কিন্তু ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেখা দেবেন না। এভাবে ধীরে ধীরে স্বাধীনভাবে স্কুলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা তৈরি করুন। প্রতিটি পর্যায় শিশুকে উৎসাহ দিতে ভুলবেন না। যেমন: ‘তুমি তো খুব সাহসী, মা ছাড়াই ক্লাস করলে’ ইত্যাদি।

– বড়দের মতোই শিশুদের মধ্যে নানা উদ্বেগ, শঙ্কা, কষ্ট ও আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। সুতরাং, তাকে জানুন। তার আবেগ ও ভাবনা প্রকাশ করতে দিন। অহেতুক কোনো ভীতি থাকলে সে বিষয়ে আশ্বস্ত করুন। 
– দিনের কত ঘণ্টা আপনি তার সঙ্গে কাটান, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং যে সময়টা আপনি তার সঙ্গে আছেন, সেটা কীভাবে কাটাচ্ছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সঠিক সাহচর্যই পারবে সব শঙ্কা দূর করতে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ