মেয়ের অ্যালবাম সাজুক পিরিয়ডের প্রথম দিনের খুশিময় স্মৃতিতে
পিরিয়ড শব্দটিতে লুকিয়ে আছে নারীর সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা। এই শব্দটিতে নারীর মধ্যে উদয় হয় লজ্জা, আতংক, দ্বিধা। একজন নারী যতই আধুনিক হোক না কেন সে প্রত্যেক মাসের কয়েকটা দিনের জন্য শারীরিক ও মানসিক ভাবে অনেকটাই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। আর সেটির একমাত্র কারণই হলো নারীর পিরিয়ডকে কখনোই সামাজিক দৃষ্টিতে স্বাভাবিক ভাবে দেখা হয় না। এটি নিয়ে একটা বিশেষ ট্যাবুতেই রয়ে গেছে সভ্যতা থেকে সভ্যতা, সমাজ থেকে সমাজ, যুগের পর যুগ।
এটি চিরন্তন যে মানবজাতির জন্মপ্রক্রিয়া থেমে যেত যদি নারীদের পিরিয়ড না হতো। কিন্তু মানবজাতির জন্মের সাথে সম্পৃক্ত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আমাদের কুসংস্কারের শেষ নেই। পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, গণপরিবহন, দোকান-পাট সবখানেই বিষয়টি নিয়ে চলে গোপনীয়তা। স্পষ্ট উচ্চারণে কেউ বলতে পারেনা পিরিয়ডের কথা। এই কুসংস্কারের মূলে রয়েছে, বিষয়টি সম্পর্কে মানুষের সঠিক জ্ঞান এবং সচেতনতার অভাব। আসলে সত্যিকথা বলতে এর জন্য আমাদের সমাজব্যবস্থাই দায়ী। কারণ এসমাজ বিষয়টিকে এমনভাবে নিষিদ্ধ করে রেখেছে যে কেউই এ বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে পারে না।
আজও বাবা, মা ও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান একসাথে বসে টিভির পর্দায় ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখতে পারেন না। এমনকি স্কুল-কলেজের শারীরিক শিক্ষা বইয়ের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তনের অনুশীলনীগুলো সুকৌশলে এড়িয়ে যান শিক্ষকরা। অথচ একটু খোলামেলাভাবে বললেই মেয়েরা যেমন তাদের শরীর সম্পর্কে সচেতন হতে পারত, তেমনি ছেলেরাও জানতে পারত এই সময়টাতে মেয়েদের ঠিক কী হয়। আর এতে ছেলে মেয়ে কাউকেই লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই।
সাধারণত পিরিয়ডের কারণ হিসেবে বলা হয় যে, বাচ্চা হওয়ার জন্য এটি সব নারীরই একটা বয়সে হতে হয়। আর বাচ্চা হওয়ার যে প্রক্রিয়া এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে ছেলেদের ভেতর একধরনের কৌতূহল কাজ করে। আর মেয়েদের এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও জ্ঞানের অভাবের কারণে এটি পরিনত হয়েছে একটা ট্যাবুতে। তবে এখনও যদি এই ট্যাবু না ভাঙা হয় তাহলে আগামী প্রজন্ম সামনে এগোতে পারবে কতটা তা নিয়ে ভাবতে হবে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে আমাদের দেশের ৭১ শতাংশ মেয়েই এই বিষয়ে জানেনা। আর তাই এক্ষেত্রে হাইজিন এর বিষয়টিও উপেক্ষিত থেকে যায়। তাই লুকোছাপা না করে পিরিয়ড শুরুর আগেই এই বিষয়ে মায়েদের উচিত তার মেয়েকে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখা।
এই সময় পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা কতটা জরুরি, ভালো করে মেয়েকে বোঝানো প্রতিটি মায়েরই উচিত। যেহেতু এই সময়টা মেয়েদের কাছে খুব স্পর্শকাতর। তাই কোনও ট্যাবুতে আটকে না থেকে মেয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলা মায়েদের দায়িত্ব হওয়া উচিত। যেন আর কারোর কাছ থেকে বিকৃত তথ্য শুনে তার মনে পিরিয়ড সম্পর্কে কোনও ভুল ধারণা গড়ে না ওঠে সে দিকে সচেতন থাকাটাও জরুরি।
আসলে পিরিয়ড যে কোনো রোগ নয়৷ প্রতিটা নারীর জীবনচক্রের এটা একটা অংশ৷ তাই প্রতিটা মেয়ে যাতে মাসিককে আতঙ্ক হিসেবে না দেখে স্বাভাবিকভাবে দেখতে শেখে এবং সচেতন হয়, সেজন্য পরিবারেরই ভূমিকা পালন করা জরুরি৷প্রত্যেক বাবা কিংবা মা যদি একটি নির্দিষ্ট বয়সে বা মাসিক হওয়ার পর মেয়েদের সাথে খোলাখুলি আলোচনা করেন, তাহলে ব্যাপারটা তাদের মেয়ের জন্য অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক হতে পারে৷
এদিকে মাসিকের সময় অনেকের প্রচণ্ড তলপেট ব্যথা হয়। অনেক মেয়ে ব্যথায় প্রায় মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে অথচ তাদের ডাক্তারও দেখানো হয় না৷ কেন তার এতটা ব্যথা হয় এ নিয়ে পরিবারের কোনো মাথা ব্যথাও নেই৷
পিরিয়ডের প্রথম অবস্থায় যেসব সমস্যা দেখা যেতে পারে সে সম্পর্কে গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. খাদিজা বলেন, শরীরে হরমোনের মাত্রা এক একজনের এক এক রকম৷ তাই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে শারীরিক অস্বস্তিটাও ভিন্ন হতে পারে৷ কারো কারো মাথা ব্যথাও হয়, অনেকের বমি বমি লাগে৷ বেশিরভাগ মেয়েদের যেটা খুবই দেখা যায় সেটা হলো এ সময়ে অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে যাওয়া৷
তাই মা হিসেবে মেয়ের পাশে গিয়ে আগে দাঁড়ানো উচিত। সাধারণত মেয়েরা মায়ের কাছেই এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর এর জন্য প্রথম পিরিয়ডের সময় মেয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। এই সময় প্রচুর মুড সুইং হয়, তাই শারীরিক যত্নের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর খেয়াল রাখা জরুরী।
মায়েরা তাদের প্রথম অভিজ্ঞতা মেয়ের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। পিরিয়ড হয়ে গিয়েছে মানে দুনিয়ার সবার কাছে এটা বলার দরকার নেই যে মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে! এই ধরনের কথায় মেয়েটার ছোট মনে অজানা অস্থিরতা চলে আসতে পারে। তাই যতটা পারা যায় সহজ ভাবনা দেয়া উচিত সব মায়েদেরই তাদের মেয়েটির প্রতি।
অনেকে প্রথম পিরিয়ডের সময় তার মায়ের কাছে নানা জিজ্ঞাসা থাকে এ ব্যাপারে। তাই মেয়েটিকে বিষয়টি সম্পর্কে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলা মায়েদের দায়িত্ব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত ১০-১৬ বছর বয়সে প্রথম পিরিয়ড হয়। তবে শারীরিক গঠনভেদে বয়সের তারতম্য হতে পারে। শরীরের ফ্যাট ও মোট ওজনের উপর নির্ভর করে এর অনুপাত নির্ভর করে। আবার অনেকের একটু দেরি হতে পারে। তবে মেয়ের বয়স ১৪ পেরিয়ে যাওয়ার পরও যদি পিরিয়ড শুরু না হয় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি। আবার যদি ছ’বছর বয়স হওয়ার আগেই পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়, তাহলে অবশ্যই তা চিন্তার বিষয়।
শরীরে হঠাৎ এমন পরিবর্তন অনেক মেয়েই মেনে নিতে পারে না। তাদের মনে ভয় বা স্ট্রেস কাজ করে। কেউ কেউ এই সময় ভয়ে কুঁকড়ে যায়। সেক্ষেত্রে একজন মাই পারেন তার মেয়ের ভীতি কাটাতে। এ জন্য অবশ্যই মেয়ের সঙ্গে মায়েদের হতে হবে সহজ।
মেয়ের পিরিয়ডের প্রথম দিনটিকে উদযাপন করা উচিত খুশির সঙ্গে। এদিনটিকে স্মৃতিময় করে তুলতে মেয়ের পছন্দের কোনও খাবার রান্না করা যেতে পারে কিংবা বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যাওয়া যায়। তাকে পছন্দের কিছু উপহার দিয়ে বিষয়টি সহজ স্বাভাবিক করে তোলা যায়। এছাড়া কেক কেটে তার সঙ্গে ছবি তুলে মুহুর্তকে আনন্দময় করে তুললে বিষয়টি নিয়ে মেয়েটি খুব সহজ করে ভাবতে শিখবে।
এছাড়া পিরিয়ডের সময় সবচেয়ে জরুরি যেটি তা হলো হাইজিন, তাই লুকোছাপা না করে পিরিয়ড শুরুর আগে থেকে এই বিষয়ে মেয়েকে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখলে ভালো। প্রতি ৪ ঘণ্টা অন্তর প্যাড বদল করার পরামর্শ দিতে হবে। পিরিয়ডের সময় যোনির চারপাশ সব সময় পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দিতে হবে। যাতে ইনফেকশনের ঝুঁকি এড়ানো যায় সহজেই। পরিষ্কার ও আরামদায়ক পোশাক পরার পরামর্শ দিতে হবে। এই সময় টাইট ও অপরিষ্কার কাপড় থেকে ঘষা লেগে ইনফেকশনের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
স্কুলে অথবা কলেজে যেন মেয়েটি কখনো অস্বস্তিতে না পরে সেজন্য তার ব্যাগে একটি কিংবা দুটি প্যাড গুছিয়ে দেয়াটাও জরুরী। এতে একটা মানসিক স্বস্তি মা এবং মেয়ে দুজনেই অনুভব করবেন।
সাধারণত একটি মেয়ের ৮-১২ বছরের মধ্যে ঋতুস্রাব শুরু হতে পারে। মেয়ের বয়স যদি ৮-১২ বছরের মধ্যে হয় তাহলে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলে তাকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করে তোলা প্রতিটি মায়ের জন্য স্বস্তিজনক।