লিভার ভালো নেই!
মানব দেহের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল লিভার (যকৃত)। লিভার হলো মানব দেহের একটি ‘পাওয়ার হাউস’ যার সুস্থতার উপর আমাদের দেহের অন্যান্য অনেক কিছুই নির্ভর করে। লিভার সুস্থ রাখতে লিভারের জটিল রোগসমূহ সম্পর্কে আমাদের সবার সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ লিভারের রোগের লক্ষণাদি সহসাই প্রকাশ পায় না। লিভারের রোগসমূহের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস অন্যতম। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে প্রায় এক কোটি মানুষ আক্রান্ত। বাংলাদেশে হেপাটাইটিস সংক্রমণকে দেখা হচ্ছে নীরব ঘাতক হিসেবে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধিতে এ রোগের লক্ষণ, প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় করণয় সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো।
ভাইরাল হেপাটাইটিস
হেপাটাইটিস হলো লিভারে প্রদাহ, সাধারনত হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাস দ্বারা প্রদাহ কে ভাইরাল হেপাটাইটিস বলে। আমরা অনেকেই এই ধরনের রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে তাকে জন্ডিস বলি।
যেভাবে ছড়ায়
হেপাটাইটিস এ এবং ই ভাইরাস খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়। এগুলোর সংক্রমণে যে জন্ডিস হয়, তা সাধারণত সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়। কিন্তু হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস অনিরাপদ যৌনসংসর্গ, অনিরাপদ রক্ত গ্রহণ, ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ, একাধিক ব্যক্তির একই ব্লেড-কাঁচি ব্যবহার, অনিরাপদ দাঁতের চিকিৎসা বা বিভিন্ন অনিরাপদ অস্ত্রোপচার এবং সন্তান জন্মদানের সময় আক্রান্ত মা থেকে শিশুতে সংক্রমণ হতে পারে।
ভাইরাল হেপাটাইটিস এর লক্ষণ
জন্ডিস, খাবারে অরুচি, উপরের পেটের ডান দিকে বা মাঝখানে ব্যথা, বমি বমি ভাব ও বমি, দুর্বলতা ও জ্বর। হেপাটাইটিস বি এবং সি দীর্ঘমেয়াদে লিভার সিরোসিস করতে পারে যা কিনা একটি মারাত্মক ও অনিরাময়যোগ্য রোগ। সাধারণত খাদ্যে অরুচি, ওজন হ্রাস, বমি ভাব বা বমি, বমি বা মলের সঙ্গে রক্তপাত, শরীরে পানি আসা ইত্যাদি হলো লিভার সিরোসিসের মূল উপসর্গ। পরে যকৃতের অকার্যকারিতার সঙ্গে কিডনির অকার্যকারিতা, রক্তবমি, রক্তে আমিষ ও লবণের অসামঞ্জস্য ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয়।
চিকিৎসা
এ এবং ই ভাইরাস সংক্রমণজনিত হেপাটাইটিস বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আপনা আপনি ভালো হয়ে যায়। অল্প কিছু ক্ষেত্রে শুধু বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। রোগ ধরা পরার পর কেউ অস্থিরতা, অস্বাভাবিক আচরণ করলে বা অজ্ঞান হলে, এটা মারাত্মক জরুরি অবস্থা। তাকে অনতিবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
বি ভাইরাস নির্মূল করা না গেলেও চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অনেকের ধারণা, হেপাটাইটিস বি বা সি সংক্রমণ হলে আর কোনো আশা নেই, লিভার বা যকৃত নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমানে এ দুটো ভাইরাস নির্মূলের জন্য আধুনিক অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি রয়েছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সি ভাইরাসও চিকিৎসার মাধ্যমে নির্মূল করা যায়। এ ছাড়া হেপাটাইটিস এ ও বিএর প্রতিষেধক টিকা আছে, যার মাধ্যমে এসব ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব।
প্রতিরোধের উপায়
– প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ লোক হেপাটাইটিস 'বি' ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। অথচ টিকা দেওয়ার মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। চার ডোজ টিকা নিতে হয়। সরকার অবশ্য ২০১০ সাল থেকে দেশের সব শিশুকে এ টিকা দিচ্ছে। কিন্তু এর আগে জন্মগ্রহণকারীদের কিন্তু এ টিকা দেওয়া হয়নি। তাই দেরি না করে টিকা দিন। তবে টিকা দেওয়ার আগে ঐইংঅম পরীক্ষা করে দেখুন। যদি এর মান নেগেটিভ থাকে তাহলে আর দেরি নয় টিকা নিন।
– রক্ত গ্রহণের আগে অবশ্যই পরীক্ষা করে নিতে হবে যে এই রক্ত ভাইরাসমুক্ত।
– ডিসপসেবল সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে।
– হেপাটাইটিস 'বি' পজিটিভ মায়ের শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাকে টিকা ও অ্যান্টিবডি দিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে।
– ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক বা আচরণ পরিহার করতে হবে।
– ব্যক্তিগত ব্যবহার করা ট্রুথব্রাশ, রেজর, নেইল কাটার ইত্যাদি অন্যকে ব্যবহারে নিষেধ করতে হবে।
– সেলুন, বিউটি পার্লারে নাক, কান ফোঁড়ানোর সময় বা চুল কাটার সময়, শেভ করাজীবাণুমুক্ত জিনিসপত্র ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
– বাচ্চাদের হেপাটাইটিস 'এ' ভাইরাসের টিকা দিতে হবে।
– বিশুদ্ধ পানি ও খাবার গ্রহণ করতে হবে।
ডা. শারমিন তাহমিনা খান সানভী
এমবিবিএস , এমডি (গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি)
পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল