Skip to content

১৪ মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৩০শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিচ্ছেদে নারীরাই কেন অবজ্ঞার শিকার হন?

বিবাহ বিচ্ছেদ বর্তমান সময়ে একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। তবে একটা সময়ে এতোটা সহজ ছিল না বিচ্ছেদ। ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ছিল প্রতি ১০ হাজারে যথাক্রমে ৭ ও ৮টি। এই হার ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৫টিতে।  ২০২৩ সালে বিচ্ছেদের হার ছিল প্রতি ১০ হাজারে ১১টি। তবে গত বছর দেশে সার্বিকভাবে বিচ্ছেদের হার কমেছে। বিচ্ছেদের কারণে নারী ও পুরুষ উভয়েই প্রভাবিত হন।

বিচ্ছেদ একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হলেও সমাজে এর প্রভাব নারী ও পুরুষের ওপর সমানভাবে পড়ে না। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিচ্ছেদের পর নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপের সম্মুখীন হন। সমাজ বিজ্ঞানী ও মনো বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিচ্ছেদের পর নারীর জীবনে অনিশ্চয়তা ও অপমানের মাত্রা অনেক বেশি যা তাকে গভীর মানসিক আঘাত বা ট্রমার দিকে ঠেলে দেয়।

এই বৈষম্যের মূল কারণ আমাদের সমাজের প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো, অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য, নারীকে দোষারোপ করার প্রবণতা ও বিচ্ছেদ পরবর্তী সামাজিক পুনর্বাসনের অভাব। ফলে নারীরা বিচ্ছেদের বিষয়ে মুখ খুলতে ভয় পান, বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চান এবং একা লড়াই করতে বাধ্য হন।

সমাজব্যবস্থা নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো এখনো পিতৃতান্ত্রিক যেখানে নারীর মূল পরিচয় নির্ধারিত হয় তার বৈবাহিক অবস্থা দ্বারা। একজন নারী বিবাহিত থাকলে তাকে সামাজিকভাবে “সম্পূর্ণ” হিসেবে গণ্য করা হয় আর তালাকপ্রাপ্ত হলে “পরিত্যক্ত” বা “ব্যর্থ” তকমা দেওয়া হয়। অপরদিকে পুরুষের বিবাহ বিচ্ছেদকে সমাজ তেমন গুরুত্ব দেয় না। একজন তালাকপ্রাপ্ত পুরুষ সহজেই পুনরায় বিয়ে করতে পারেন, কিন্তু নারীর জন্য এটি সামাজিকভাবে কঠিন হয়ে ওঠে। অনেক সময়ই পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীরা একজন তালাকপ্রাপ্ত নারীকে অসম্মানজনকভাবে দেখেন,
যা তার সামাজিক ও মানসিক অবস্থাকে আরও দুর্বল করে দেয়।

বিচ্ছেদের জন্য নারীকে দায়ী করা
সংসার ভাঙার জন্য নারীকেই প্রধানত দায়ী করা হয়। প্রচলিত ধারণা হলো, একজন ভালো স্ত্রী সব রকম পরিস্থিতি সহ্য করেও সংসার টিকিয়ে রাখেন। তাই যখন বিচ্ছেদ হয়, তখন সমাজের একটি বড় অংশ মনে করে ওই নারী কোনো না কোনো ভুল করেছেন বলেই স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। যদি স্বামী প্রতারণাও করে বা অন্য কারণে বিচ্ছেদ হয়, তবুও নারীকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়
-সে কি ঠিকভাবে সংসার করতে পারেনি?
-সে কি স্বামীকে যথেষ্ট সম্মান দেয়নি?
-তার চরিত্র নিয়ে কি কোনো সমস্যা ছিল?
অন্যদিকে পুরুষ যদি তালাকপ্রাপ্ত হন, তবে সাধারণত সমাজ সেটিকে তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখে এবং তাকে তেমন কোনো সামাজিক বাধার মুখে পড়তে হয় না।

অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য
বাংলাদেশের নারীরা এখনও পুরুষদের তুলনায় কম আয়ের সুযোগ পান এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংসারের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত পুরুষের হাতে থাকে। ফলে তালাকের পর নারীদের জন্য নতুন করে শুরু করা কঠিন হয়ে পড়ে। যে নারী চাকরিজীবী নন বা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী নন, তার জন্য তালাকের পর জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে যায়। সন্তান থাকলে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্বও মায়ের ওপর পড়ে যা আর্থিক চাপে আরও বৃদ্ধি করে। এমনকি কর্মজীবী নারীদের ক্ষেত্রেও তালাকের পর চাকরিস্থলে বৈষম্যের শিকার হওয়ার নজির রয়েছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই আর্থিক চ্যালেঞ্জ কম থাকে কারণ তারা সাধারণত কর্মসংস্থান ও সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সহজেই জীবনের গতি ধরে রাখতে পারেন।

তালাকে সামাজিক ট্যাবু
তালাককে এখনও সমাজে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। অনেক নারী তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি গোপন রাখতে চান কারণ এটি প্রকাশ পেলে তাকে সহানুভূতির বদলে করুণার চোখে দেখা হয়। একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী নতুন করে সম্পর্ক গড়তে চাইলে সমাজ সেটিকে ভালোভাবে নেয় না। অনেকে তাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। এমনকি তার চরিত্র নিয়েও গুজব রটানো হয়। অন্যদিকে একজন তালাকপ্রাপ্ত পুরুষ সহজেই সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যান এবং পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রেও তার জন্য সুযোগ বেশি থাকে।

সন্তান লালন-পালনে বাড়তি চাপ
বিচ্ছেদের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তান মায়ের কাছেই থাকে। তবে একক মায়ের জীবনযাত্রা সহজ নয়। সামাজিকভাবে একা মাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে তাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। সন্তান যদি ভালোভাবে বড় না হয় তাহলে দোষটাও এককভাবে মায়ের ওপরই চাপানো হয়। অন্যদিকে তালাকপ্রাপ্ত পিতার জন্য এই চাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। কারণ তিনি সাধারণত সন্তান লালন-পালনের মূল দায়িত্ব নেন না।

পুনর্বিবাহে সামাজিক বাধা
একজন তালাকপ্রাপ্ত পুরুষ সহজেই নতুন জীবনসঙ্গী খুঁজে নিতে পারেন কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এটি অনেক জটিল। সমাজ মনে করে, একজন নারী একবার বিবাহবিচ্ছেদ করলে তিনি আর সহজে ভালো পাত্র পাবেন না। অনেক ক্ষেত্রেই নারীর পরিবারের সদস্যরা তাকে পুনরায় বিয়ে করতে নিরুৎসাহিত করেন বা সামাজিক ভয় দেখান। ফলে অনেক নারী একাকীত্ব ও হতাশার শিকার হন। অনেকেই বাধ্য হয়ে তালাকপ্রাপ্ত হয়েও মানসিক বা সামাজিক কারণে নতুন সম্পর্কে জড়াতে পারেন না।

অবজ্ঞা কমাতে পদক্ষেপ
বিচ্ছেদ পরবর্তী সামাজিক অবজ্ঞা কমাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিচ্ছেদকে ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে ব্যক্তি স্বাধীনতার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নারীদের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে যাতে বিচ্ছেদের পর তারা নিজের জীবন পরিচালনা করতে পারেন। বিচ্ছেদপ্রাপ্ত নারীদের জন্য কাউন্সেলিং ও সাপোর্ট গ্রুপ গঠন করা উচিত। বিচ্ছেদের পর নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে যাতে তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার পান। সমাজকে বুঝতে হবে বিবাহবিচ্ছেদ জীবন শেষ করে দেয় না। এটি একটি নতুন শুরুর সুযোগও হতে পারে।

বিবাহ বিচ্ছেদ নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই কঠিন একটি অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীদের জন্য এটি আরও বেশি অপমানজনক ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে নারীদের প্রতি বৈষম্য মূলক আচরণ দূর করা জরুরি। সমাজ যদি নারীদের বিচ্ছেদ পরবর্তী জীবনকে সহজ করে তুলতে পারে, তবে তারা আরও স্বাধীন, আত্মবিশ্বাসী ও সফল হতে পারবেন।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ