যে কারণে ২৩৫ বছরেও নারী প্রেসিডেন্ট পায়নি যুক্তরাষ্ট্র
২৩৫ বছরেও যুক্তরাষ্ট্র কোনো নারী প্রেসিডেন্ট পায়নি। হোয়াইট হাউসের ক্ষমতা পাওয়ার মূল দৌড়ে অংশ নিয়েছেন মাত্র দুজন নারী প্রার্থী। কিন্তু ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিচক্ষণ রাজনীতিক ডেমোক্রেটিক হিলারি ক্লিনটন হেরেছিলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। সবশেষ ৫ নভেম্বরের নির্বাচনেও সেই ট্রাম্পের কাছেই হারলেন কমলা হ্যারিস। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখনও নারীর নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার অবস্থায় আসেনি আমেরিকার জনগণ।
১৯১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী পাসের মাধ্যমে আমেরিকান নারীরা প্রথম ভোটের অধিকার পান। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রিপাবলিনা মার্গারেট চেস স্মিথ প্রথম প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। তিন দফায় যুক্তরাষ্ট্রের মেইন অঙ্গরাজ্যের সিনেটরের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। যেদিন মার্গারেট প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন সেদিনই গণমাধ্যম সেটিকে নন সিরিয়াস বা তেমন গুরুতর নয় বলে সম্বোধন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকায় নারীদের কাজ করার তেমন সুযোগ ছিল না। ষাটের দশকে নারী আন্দোলনের পর থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয়। তবে তখনও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে নারী উপস্থিতি বাড়েনি।
১৯৭৭ সালে করা এক মার্কিন জরিপ অনুযায়ী, ৫০ শতাংশ জনগণ মনে করেন নারীরা আবেগি সিদ্ধান্ত নেয় দেখে তাদের রাষ্ট্রপরিচালনায় না আসাই ভালো। এরপর মার্কিন রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে মার্কিনি নারীদের লড়াই চলতে থাকে। বড় পরিবর্তন আসে ২০০৮ সালে। ওই বছর ডেমোক্রেটিক হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াইয়ের ঘোষণা দেন। তিনি পুরুষদের মতো প্রচার চালাতে থাকেন। তখনও আমেরিকার গণমাধ্যম হিলারির সৌন্দর্য, গলার স্বর, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতে থাকে। ওই বছর প্রাইমারিতে বারাক ওবামার কাছে হেরে যান হিলারি। আট বছর পর হিলারি আগের মতো আর ভুল করেননি। এবার তিনি নারী হয়েই প্রচার চালাতে শুরু করেন। ওই বছর তিনি প্রাইমারিতে বার্নি স্যান্ডার্সকে হারিয়ে হোয়াইট হাউসের ক্ষমতা পাওয়ার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পান।
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম নারী প্রার্থী হন হিলারি ক্লিনটন। সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেওয়ায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন তিনি। ৩০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েও ইলেক্টোরাল কলেজের নিয়মে পরাজিত হন ট্রাম্পের কাছে। দেখা যায়, ট্রাম্প পুরুষ ভোট পান ৫২ শতাংশ আর হিলারি পান ৪১ শতাংশ। এবারও সবশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, পুরুষ ভোটারদের কাছে কমলার চেয়ে ট্রাম্পই জনপ্রিয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সব যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কেবল নারী হওয়ায় বিদ্বেষের শিকার হন হিলারি। তবে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে নারী নেতৃত্বকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তার প্রমাণ, এরই মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড গড়েছেন কমলা।
নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গসমতা নিয়ে ব্যাপক সরব যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সে দেশে এখনও নির্বাচিত হননি কোনো নারী প্রেসিডেন্ট। অথচ ইউরোপের অনেক দেশেই নারী হয়েছেন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। এত প্রগতিশীল হয়েও মার্কিনদের কেন রক্ষণশীল মনোভাব, প্রশ্ন বিশ্বজুড়েই।
এবারও ঘুরপাক খাচ্ছে একই প্রশ্ন, আমেরিকার জনগণ কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্টের সিংহাসনে বসাবে কিনা? যদিও তিন মাস আগেও ধারণা ছিল না, ২০২৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন কমলা হ্যারিস। জুলাইয়ে নির্বাচনি বিতর্কে ট্রাম্পের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অভিজ্ঞ ট্রাম্পের বিপক্ষে সুযোগ পান কমলা। কিন্তু আশাহত হতে হলো তাকে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আমেরিকায় পুরুষদের তুলনায় নারীদের ক্ষমতা এবং দক্ষতা সম্পর্কে জনসাধারণ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও গণমাধ্যমের কাছ থেকে নেতিবাচক ধারণার মুখোমুখি হতে হয়। লিঙ্গবৈষম্য, রাজনীতিতে সীমিত অংশগ্রহণ এবং তাদের যোগ্যতার অবমূল্যায়নের কারণে পুরুষদের তুলনায় নারীদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অন্য দেশের তুলনায় জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতা বেশি, যা নারীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। জার্মানি, যুক্তরাজ্যের মতো সংসদীয় ব্যবস্থায় নারীদের ক্ষমতা অর্জন করা সহজ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর আমেরিকান উইমেন অ্যান্ড পলিটিক্সের পরিচালক ডেবি ওয়ালশ ব্যাখ্যা করেছেন, সংসদীয় ব্যবস্থায় নারীদের ক্ষমতায় যাওয়ার অনুকূল কারণ সেখানে আপনি রাষ্ট্রপ্রধানকে ভোট দেন না। সেখানে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এই দল নারী নেতৃত্ব অর্জনের জন্য আরও কাঠামোগতভাবে কাজ করতে পারে।
যদি যুক্তরাষ্ট্রে একটি সংসদীয় ব্যবস্থা থাকত, তাহলে ন্যান্সি পেলোসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন।