লেখালেখিও নারীর জন্যে চ্যালেঞ্জিং
লি ও তলস্তয়ের হাতের লেখা অত সুবিধার ছিল না। দিনের পর দিন তার হাতের লেখা দেখে অনুলিখন করতেন তার স্ত্রী। । তার স্ত্রী যদি তাকে সাহায্য না করতো তাহলে আসলে কোনোদিনই তলস্তয়ের এত লেখা আমাদের সামনে আসতো না। তবে লেখালেখির ক্ষেত্রে নারীদের জন্য সবসময়ই চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। পশ্চিমা বিশ্বে যখন লেখক পরিচয়টাই অনেক আমাদের দেশে নারী লেখক বা নারীবাদি লেখনীর বিষয় নিয়ে তর্ক হয়েছে অনেক। লেখক তো লেখকই, তাকে নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে আলাদা করা ঠিক নয়’। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা কী বলে? প্রকৃত বাস্তবতা হলো, সমাজ সংসারে নারীদের একটি সীমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বেশ কয় বছর আগে জাপানি কথা সাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির এক সাক্ষাৎকারের কথা টানা যেতে পারে। ওই সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের সবচে প্রয়োজনীয় কোন গুণটি থাকতে হয়? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘মেধা, মনঃসংযোগ আর সহিষ্ণুতা’। প্রতিদিন লেখার টেবিলে বসে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর একজন নারীর মনঃসংযোগ দেয়ার সময় কোথায়? একজন পুরুষ লেখককে পরিবারের সদস্যরা রোজ পড়ার টেবিলে বসে কিছু শেখা বা অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়। এতে আপনা থেকেই মনঃসংযোগ হয়। ফলে তারা নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে লেখার জন্যে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো আত্মস্থ করতে পারে।
লেখালেখি বাংলাদেশে একটি পেশা হিসেবেও অতটা স্বীকৃত নয়। ক্রিয়েটিভ রাইটিং বাংলাদেশে এখনও অতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। নারীদের লেখালেখির বেসিক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার বিষয়েও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে অনেক। নারীদের তুলনায় পুরুষ লেখকদের এখনও বেশি কদর করা হয়। অনুদিত মোট বইয়ের মাত্র ৩০ শতাংশের লেখক নারী। সাহিত্য পুরষ্কার, বইয়ের সমালোচনা, প্রকাশনা শিল্পের বড় পদের চাকরি ইত্যাদি সবখানে নারী-পুরুষের বৈষম্য রয়েছে। লন্ডন রিভিউ অফ বুকসে ২০১৬ সালে যেসব সমালোচনা ছাপা হয় তার মাত্র ২৬ শতাংশ নারী লেখকদের সৃষ্টি নিয়ে। বই বিক্রির প্রশ্নে অবশ্য নারীরা পিছিয়ে নেই। বেস্ট সেলারদের তালিকায় নারী লেখকদেরই জয়জয়কার। সর্বাধিক বিক্রিত ১০ জন সাহিত্যিকের মধ্যে নয় জন্যই হচ্ছে নারী। মার্গারেট অ্যাটউড, সেরা পেরি কিংবা হেলেন ডানমোরকে নিয়ে সেরা ১০-এর যে তালিকা তাতে মাত্র একটি নাম পুরুষ। তিনি হলেন হারুকি মুরাকামি।
পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী লেখকদের নিয়ে অনেক উন্মাদনা থাকলেও আমাদের দেশে নারী লেখকদের বই প্রকাশই এক বিড়ম্বনা। নারী গল্পকার হলে কিছুটা লাইমলাইট পান। কিন্তু কবি হওয়াটা বোধহইয় সব নারীর ভাগ্যে জোটে না।
নারী তার নারী পরিচয়ের জন্য শুরুই করেন নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে। পাঠক কিংবা সম্পাদক নারীর লেখা হাতে নেন, প্রচলিত ধারণায়। নারী আর এমন কী লিখবে! এই মাইন্ডসেট থেকে তাকে বের করে আনা নারী লেখকের প্রথম চ্যালেঞ্জ। তার কন্টেন্ট, তার ভাষা ‘নারীসুলভ’ নয়-এটা প্রমাণ করে তাকে জায়গা করে নিতে হবে মূলস্রোতে। প্রশ্ন উঠতে পারে কী সেই নারী সুলভতা? ভাষা কিংবা কন্টেন্টের দুর্বলতা, জীবনকে না দেখার সীমাবদ্ধতা, না পড়ার, না দেখার, না জানার স্পষ্ট ছাপ। অস্বীকার করার উপায় নেই এর সব কটি সংগত কারণেই নারীর লেখায় উপস্থিত থাকতে পারে। উপস্থিত থাকতে পারে দেশ-কালের পরিপ্রেক্ষিতে যাপিত জীবনের কারণে। কিন্তু এসব তো পুরুষদের লেখাতেও থাকে।
একসময় নারীর জন্য আলাদা পাতা ছিল দৈনিকে, সাময়িকীতে। রান্নাবান্না, রূপচর্চা, ঘর গেরস্তালি ছিল এসব পাতার বিষয়। সাহিত্যও ছিল টুকটাক। কিন্তু ফুল, লতাপাতা, পুতুপুতু প্রেম ছিল সেসব সাহিত্যের উপজীব্য। সমাজবীক্ষণ নেই, বোধ নেই, দর্শন নেই। জীবনকে গভীর থেকে দেখার ছাপ নেই। চেষ্টাও নেই। নারী পাতা থেকে মূলস্রোতে আসতে হয়েছে। সেই আসার পথ খুব মসৃণ নয়। কিন্তু মূলস্রোতের লেখক হিসেবে নারীর লেখক যাপনও যন্ত্রণাময়।