অন্য আকাশের তারা বিভা চৌধুরী
পৃথিবী থেকে ৩৪০ আলোকবর্ষ দূরে বাংলা নাম! ভাবা যায়! হলদে-সাদা রঙের এক খুদে নক্ষত্র পৃথিবী থেকে এত দূরে ঝিকমিক করছে যে চাইলেও আমরা জীবদ্দশায় সেখানে পৌছুতে পারবো না। অথচ বিভা নামটি কত দূরে জ্বলছে। হ্যাঁ, বিভা নামে একটি নক্ষত্রের নাম বাঙালী এক বিজ্ঞানীর নামে। সৌরজগতের বাইরে যেকোনো গ্রহকেই বলা হয় এক্সোপ্ল্যানেট। এই নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করা একটি গ্রহের নাম রাখা হয়েছে সান্তামাসা। সংস্কৃত শব্দটির অর্থ মেঘে ঢাকা। অর্থাৎ মেঘে ঢাকা গ্রহের তারা বিভা। অথচ কালক্রমে বাংলা যেন এই অসামান্য প্রতিভাধর অনন্যাকে ভুলতে বসেছে।
পেশায় অত্যন্ত দক্ষ এক ভৌতবিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন বিভা চৌধুরী। অথচ খ্যাতির আলো তাকে কোনোদিন গাঢ়ভাবে স্পর্শ করেনি। অথচ বিভা চৌধুরীর সময়ে তার অর্জন আধুনিক যুগের যে কারও কাছেই ঈর্ষনীয় ঠেকবে। তিনিই ভারতীয় নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে অন্তত পদার্থবিজ্ঞানে মেধার সাক্ষর রাখতে পারেন এমন নারী উপমহাদেশে বেশ বিরল। অথচ এক কঠিন সময়েও মেধার জোরে নিজেকে কত আলোকবর্ষ দূরে দীপ্যমান করেছেন তা একবার ভেবে দেখেছেন কি?
বিভা চৌধুরী ভাগ্য মানতেই হবে। কলকাতায় এমন পরিবারে জন্ম নেন সেখানে মেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ-সুবিধার ওপর বিধিনিষেধ ছিল না। বেথুন স্কুল উতরে তাই অনায়াসে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি ডিগ্রি নেন। সে সময় এই কলেজে স্বামী বিবেকানন্দ ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো মহারথীরাও অধ্যয়ন করেন। ১৯৩৬ সালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি করে তিনি সেই সময়ে নিরব অভ্যুত্থান ঘটান। অনেকটা নিভৃতচারী ছিলেন বলেই প্রকাশ্যে তাকে নিয়ে অতটা উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। নিভৃতেই গবেষণায় মন দেন। একসময় এক সুবর্ণ সুযোগ আসে। মায়ের পক্ষের আত্নীয় ড. দেবেন্দ্র মোহন বোসের অধীনে সাবঅ্যাটমিক গবেষণা দলে ডাক পান। স্বজনপ্রীতি নয়, বিভার মেধার উপর আস্থা থেকেই এমন ডাক আসে।
দুজনে মিলে ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করে ভ্রমণকারী সাবঅ্যাটমিক কণার ট্রেইলগুলো শনাক্ত করতে সক্ষম হন। বিভিন্ন উচ্চতার দুটি পাহাড়ে তারা এই প্লেট স্থাপন করেন। এই প্লেট দিয়ে শুধু সাবঅ্যাটমিক নয় বরং বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের সময় এসব কণা কিভাবে ক্ষয় হয় তাও বোঝা যাচ্ছিল। বিভার পরিশ্রমে এই প্লেট ও দুটি নতুন কণা আবিষ্কৃত হয়। দুটো কণার নাম ম্যাশন ও মওন। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এটি একটি ল্যাপটন। এই আবিষ্কারটি সফল হলে তিনি হয়তো নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতেন। অবশ্য শিসকভারি ইন নেচার এবং অন্য জার্নালে তার আবিষ্কার প্রকাশিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে গবেষণা আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
অথচ ঠিক সাত বছর পর ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ড. সিসিল ফ্রাঙ্ক পাওয়েল পাই মেসনস ও মুনস আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। এমনকি নিজের একটি বইয়ে বিভা ও বোসের গবেষণার সাথে নিজের গবেষণার মিল স্বীকার করেছিলেন।
যাহোক, এই প্রকল্প শেষে বিভা ১৯৪৫ সালে স্যার প্যাট্রিক ব্লাকেটের অধীনে গবেষণার লক্ষ্যে ম্যানচেস্টারে যান। ‘এক্সটেনসিভ এয়ার শাওয়ার’ গবেষণার মাধ্যমে তিনি তার ডক্টরাল উপদেষ্টা হন। প্যাট্রিক একটি নতুন ক্লাউড চেম্বার আবিষ্কার করেন এবং তা ব্যবহারের মাধ্যমেই বিভা পিএইচডি লাভ করেন। প্যাট্রিক পরে এই আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পান। কাকতালীয় তো বটেই। বিভার পরবর্তী গবেষণা সম্পর্কে আমরা বেশিদূর জানিনা। তবে তার মেধা যে অনন্য সাধারণ তা বুঝতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয় না।
১৯৪৯ সালে প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে ড. হোমি জেভাভার গঠিত টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে তিনি যোগ দেন। সেখানেও নিজ কর্মদক্ষতার সাক্ষর রাখেন। ১৯৫৩ সালেই নিজ শহরে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কাজ করেন। আহমেদাবাদে গবেষণা ল্যাবরেটরিতে নিয়োগ পান। তবে দুঃখজনক তো বটেই, দীর্ঘ ১৪ বছরের গবেষণা মুছে ফেলা হয়। তার প্রতি এই অবিচার হলেও তা নিয়ে আমরা শোর তুলতে পারিনি। গবেষণায় তার অবদান সার্বজনীন করা হয়নি। বিভার অবদানও কখনো স্বীকার করা হয় না। অথচ তার সহকর্মী ও কর্মীরা অনেকেই জাতীয় পুরষ্কার বাগিয়েছেন। বিভা আজীবন গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯১ সালে মৃত্যু অবধি নিরলসভাবে গবেষণা চালিয়ে গেছেন।
তবে পরিশ্রমকে কি সহজে মুছে ফেলা যায়? ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন বিভা চৌধুরীর মহাজাগতিক রশ্মি এবং পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণায় অবদান রাখার জন্যেই একটি তারার নামকরণ করে এই অনন্যার নামে। পৃথিবীতে তাকে অবহেলা করা হলেও পৃথিবী থেকে দূরে নিজ আলোয় দীপ্তিমান বিভা বাঙালীর গর্বের কারণ হয়ে আছে।
অনন্যা/এআই