মেহজাবিনের ‘অনন্যা’: কর্মজীবী মায়ের হাহাকার!
মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের ডিরেকশনে এবং জাহান সুলতানা ও জাকারিয়া নেওয়াজের রচনায় সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত নাটক অনন্যা। যার প্রোটাগনিস্ট চরিত্র মেহেজাবিন চৌধুরী। নাটকে দেখা মেলে এক কর্মজীবী মায়ের। বায়ন্ন মিনিটের একটি ছোট নাটকে কর্মজীবী মায়েদের হৃদয়ের হাহাকার বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। ইউটিউবে মাত্র দুই দিনেই ২.৬ মিলিয়ন ভিউ হয়েছে! তার কারণ এখানে অতি পরিচিত তথা মায়েদের আঁতের কথা টেনে বের করা হয়েছে। একজন কর্মজীবী নারীর সদ্য মা হওয়া এবং তার জীবনের পরতে পরতে যে সংগ্রাম লুকিয়ে তা এখানে উঠে এসেছে।
নাটকটিতে দেখা যায় মেহজাবিন তার সন্তানকে রেখে যেদিন প্রথম অফিসে যোগদান করছে সেদিনই বস তাকে একটি ফাইল ধরিয়ে দিচ্ছেন এবং একদিনের মধ্যে তার রিপোর্ট জমা দেওয়ার আদেশ দেন। যখন সহকর্মীকে তিনি এ ব্যাপারে বলেন, এটা রিভিউ করতেই তার দুদিন সময় লাগবে তখন তার উত্তরে তিনি জানান, তিনি এতদিন ছুটি কাটিয়েছেন! এও যেন তাদের পরম উপকার! এবং এই কথার মাধ্যমে এমন ভাব প্রকাশিত হয়েছে যে, এই নারীটি আরাম-আয়েশে থাকতেই ছুটি নিয়েছিল। কোন কারণ ছাড়াই সে এতদিন অফিসমুখী হয়নি। কিন্তু এ সমাজের অধিকাংশ মানুষ ভুলে যান, মা হওয়া নারীর জীবনের আরেকটি অন্যতম প্রধান কর্ম, সামাজিক দায়, ভালোবাসার প্রতিষ্ঠা।
সমাজ-সংসার প্রতিষ্ঠায় যে নারী প্রতিনিয়ত কাঠগড়ায় দাঁড়ায় তাকে দিনশেষে পরিবার-পরিজন কেউই মূল্যায়ন করে না৷ অফিসে থেকে কাজের চাপ সামলে বাসায় এসে পরিবারের চাপ। উভয়ই নারীকে একা হাতে সামাল দিতে হয়। শুধু কর্মজীবী মা বললে ভুল হবে গৃহিণী মাকেও সর্বদা ফাইফরমাশ খাটতে হয়। তাকেও পরিবারের সবটা এক হাতে সামলাতে হয় কিন্তু তবু তিনি সন্তানকে সঙ্গ দিতে পারেন। অন্যদিকে কর্মজীবী নারীরা আরও সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ফেলেন। তাদের লড়াইটা আরও ভয়াবহ-দুর্বিষহ! একদিকে সন্তান বাড়িতে ঠিকমতো যত্নে আছে কিনা, তার ঠিক সময়ে খাওয়া হলো কিনা, ন্যাপি প্লাটানো হলো কিনা নানাবিধ চিন্তা; পরিবারের সবার চাহিদা, অফিসে পারফেক্ট হওয়ার তাগিদ!
এ সমাজে নারীকে হতে হয় পারফেক্ট। তা সবকিছুতেই। সন্তানের পারফেক্ট মা। স্বামীর পারফেক্ট বউ। শাশুড়ির পারফেক্ট বউমা। আর অফিসের পারফেক্ট কর্মচারী। এই পারফেক্ট ট্যাগটা নারীর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। পরিবার-পরিজন, সহকর্মীদের সহমর্মিতা ও সহোযোগিতা না পেয়ে নারীকে এ সময়টা কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় দিনপাত করা লাগে। নারীর লড়াইয়ের গল্প কেউ শুনতে চায় না। সবার চাহিদার শাখা-প্রশাখা গজাতে থাকে। তবু কারো কাছ থেকে একটু ভালোবাসা সহানুভূতি মায়েরা পান না!
এই নাটকে দেখানো হয়েছে একসময় ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে সে সন্তানকে অফিসে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। ছোট্ট সন্তানের যত্ন এবং অফিস দুটোই একসঙ্গে পালন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেই অফিসের সহকর্মীদের নানান অভিযোগ। শেষমেশ সে অভিযোগ গড়ায় অফিসের বসের দ্বার অবধি। আর তখনি মেহজাবিন বলেন তিনি খুব চাপে আছেন। এই পারফেকশনের দৌড়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু বসের রূঢ় আচরণ। অফিসে একটি ডে-কেয়ারের আবদার করলে বসের চড়া কথাও শুনতে হয়! অতঃপর চাকরি থেকে রিজাইন। এবং তারপরের গল্প আরও কঠিন! বাস্তবতার ঘা প্রতি পদে।
যে একসময় অফিস করে ক্লান্তির কথা বলতো না সে এখন বাড়ি থেকে করে টা কী! স্বামীকে একবেলা বাসি খাবার খেতে দেওয়া কি কখনো কোন নারীর উচিত? তিনি তো স্বয়ং প্রভু। শাশুড়িকে বলতে শোনা যায়, তিনি তার ছেলেকে বাসি খাইয়ে মানুষ করেননি! এই অতি আহ্লাদ এ সমাজকে ডুবিয়েছে। দৃষ্টি তাদের কখনও সুপ্রসারিত হয় না। তার বাড়ির বউ যেন কখনও কারো মেয়ে ছিলো না। কারো আদরের ধন ছিল না। একটি বাস্তব ও জলজ্যান্ত চিত্র পুরোটা জুড়ো। যখন চাকরি ছাড়ে তখন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার মায়ের অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে স্বামীর কাছে হাত পাতে! সেখানেও ছোট্ট পরিসরে বোঝানো হয়েছে নারী নিজে স্বাবলম্বী না হলে তার দুঃখ আরও অপরিসীম! বিড়ম্বনায় ভরা জীবন। শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনীর মতো নাটকের অনন্যা মরে প্রমাণ করেনি তার কষ্ট হয় বরং এ যুগের অনন্যা অন্য পথ খুঁজেছে। নিজেই বিভিন্ন কোম্পানির স্মরণাপন্ন হয়ে একটি ডে-কেয়ার খুলে।
যে বার্তা পৌঁছাতে নাটকটি সৃষ্টি করা হয়েছে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছালে হয়। আমরা জানি একজন মায়ের জীবনে কত দায়িত্ব। তারওপর মা যদি কর্মজীবী হন তবে সেখানে তার জীবন আরও সংকটপূর্ণ। এ সমাজ আজও বিশ্বাস করে, মায়েদের ক্ষুধা লাগলে বলতে নেই, শরীর খারাপ হতে নেই, ক্লান্তি লাগতে নেই! কর্মজীবী মা এমনই একটা ক্যারেক্টার প্লে করেন যেখানে তার বলে কিছু থাকে না। তিনি সন্তান ও পরিবারের হয়ে যান। নিজের ভালো-মন্দ কিচ্ছু তার থাকতে নেই।
সমাজ বদলের গান আমরা সবাই গাইতে পছন্দ করি। কারণ নিজেকে তাতে করে খুব প্রগতিশীল মনে হয়। কিন্তু যারা এই গান গাইতে পছন্দ করেন তার মধ্যে সিকিভাগ মানুষও কি দায়িত্বটা পালন করেন! এই মানুষগুলো কি নারীকে মূল্যায়ন করে! নারীর সংগ্রামপূর্ণ জীবনকে শ্রদ্ধা করে? পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যতটা হাত বাটা যায় তা করে! নিজের পানিটা ঢেলে খাওয়ার প্র্যাকটিস কজন পুরুষ করেন! তাজ্জব বিষয় হলেও সত্যি এ সমাজে আজও পুরুষ রাজা আর মেয়েরা তাদের প্রজা। বিয়ে করে সহধর্মিণী নয়, দুঃখ-সুখের সঙ্গিনী নয় একজন চব্বিশ ঘন্টার দাসীই যেন ঘরে আনে! এই চিত্র পাল্টাতে হবে। মনকে প্রসারিত করতে হবে। মাথায় রাখা প্রয়োজন দায় নারীর অনেক বেশি। পুরুষ যেখানে অর্থযোগান দিয়ে সবকিছু থেকে ছুটি পান নারী তা পান না। তাকে সবসময় সবার জন্য কাজ করতে হয়। ভালো-মন্দের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। এখানে পুরুষ সমাজ যদি সামান্য সহানুভূতি-সহমর্মী হয় তবে ক্ষতি কী! বরং সম্মান ও ভালোবাসার সুখের ঘর, হৃদয়ের বন্ধন সৃষ্টি হবে।