সৈয়দা নিগার বানুর প্রথম চলচ্চিত্র ‘নোনা পানি’
চলচ্চিত্র সমালোচক নই, কবিতা লিখি মাত্র। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রগুলো খুঁজে খুঁজে একটু দেখার চেষ্টা করি। এটা আমার ব্যক্তিগত শেকড়ের সন্ধানে থাকার একটা প্রয়াসওl সেই চলচ্চিত্রগুলোতে বাস্তবের চরিত্ররা কে কী বলছেন, কিভাবে বলছেন, পরিচালক নিজের সৃষ্টিসত্তাকে কিভাবে উন্মুক্ত করছেন, একটু বোঝার চেষ্টা করি।
এই বুঝতে গিয়ে কখনো কখনো দেখি গল্পের মধ্যে একটা আমার সত্তাও আমি খুঁজে পাচ্ছি। আমার বলা বা না-বলা কথাগুলো পরিচালক ভিন্ন এই মাধ্যমে সুন্দর করে তুলে আনছেন l আর তখনই আমার কবিতা সত্তা বলে উঠে যেমন দেখেছো লেখো না দুচার কলম। তোমার তো কোনো দায় নেই সমালোচক হওয়ার ।
সৈয়দা নিগার বানু খুলনার আঞ্চলিক জীবনগাথাকে সূচারু নিরীক্ষণ, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে এনেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্যয়ের ‘ নোনা পানি ‘ চলচ্চিত্রে। দীর্ঘ সাত বছরের কঠিন শ্রম এবং নিরলস গবেষণার ফসল তাঁর এই চলচ্চিত্র।
চরিত্র, স্থান, গল্প খুলনার আঞ্চলিক যাপনের চিত্রমালা হলেও, আমার এবং আমাদের পারিপার্শ্বিক চিরন্তন জীবনধারার কথা বলে। প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠ, যাতনা বেদনা পরিস্ফুটিত হয়। ফলে আমার বলা এবং না-বলা কথাও নিগারের দৃষ্টিতে আমি খুঁজে পাই। খুলনার একটা অঞ্চলের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই যেন অনেক অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গ্রামের কথা নিয়ে একটা ভুবনগ্রামের চিত্র গড়ে ওঠে ।
দশপাই নামের একজন না-পুরুষ না-নারী তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, যার মধ্যে রয়েছে আত্মপরিচয় খোঁজার সংকট, যাকে আমরা নিয়ত ভিন্ন গ্রহের মানুষ ভাবি, সেই মানুষ কেমন সহজ সরল সকলের সুখ দুঃখে মিশে যায়। আবার টিকে থাকতে না-পেরে একসময় যা করার নয় তাও করে ফেলে।
সমাজ কীভাবে প্রান্তিক শ্রেণীর নারীকে দেখে সাহায্য, পাশে দাঁড়ানোর নাম করে কীভাবে ব্যবহার করে। পুরুষের চোখে নারীর শরীর, লোলুপ বিকৃত কামনা, তা যেমন এই চলচ্চিত্রে উঠে আসে আবার অবদমনের খোলস ছেড়ে মানুষের জৈবিক যৌনতার শৈল্পিক মূল্যায়ন হয় ।
জীবনকে একমুখী কোনো দৃষ্টিতে দেখা শিল্পের কাজ নয়। মানুষের জীবনচিত্র মানুষকে কীভাবে দেখানো হবে তার ওপরে রয়েছে মূল্যায়ন। গ্রামীণ একটি কুঁড়েঘর আমরা অনেকেই দেখেছি, এ আবার এমন কী বিষয় এই বলে এড়িয়েও গিয়েছি। চলচ্চিত্রে দৃশ্যায়ন নান্দনিকতা সেই চেনা দৃশ্যকে,আমাকে এমনভাবে নতুন করে দেখায় , ভাবানোর চেষ্টা করে। ‘নোনা পানি’র আঞ্চলিক জীবন সেভাবেই আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে। প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই, অন্ধ সংস্কার, সামাজিক রাজনীতির কূটকচালি, সাম্প্রদায়িক স্নায়ুর লড়াই, জলের স্রোতের সকাল দুপুর রাত্রি সন্ধ্যা।
এই জীবন সংগ্রাম কিন্তু কোথাও এতটুকু তরলিকৃত হয়ে ওঠেনি l লঘুরসে পরিশীলিত মার্জিত থেকেছে l সোহাগ নামক ছেলেটির চরিত্র যেমন ভালো লেগেছে, আবার সোহাগের মায়ের সংলাপ,’সোহাগের মা বাঁচলে সোহাগও বাঁচবে’ ভাবিয়ে তুলেছে। অভিনেত্রী জয়িতা মহলানবিশকে মুহাম্মদ কাইয়ুমের ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ চলচ্চিত্রে দেখেছি। অসাধারণ অভিনয় করেন । একজন অভিনেত্রী চরিত্রবিশেষে কীভাবে নিজেকে ভেঙে আবার গড়ে নিতে পারেন, এই চলচ্চিত্রে দেখলাম।
এক্ষেত্রে আমার একটা সংযুক্তি হলো, বাংলার বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের যন্ত্রনার সাথে গ্ৰুপ থিয়েটারের যন্ত্রনার একটা মিল আছে। গ্ৰুপ থিয়েটারের কলাকুশলীদের আরও বেশী এ ধরণের চলচ্চিত্রে নিয়ে আসা প্রয়োজন । এতে অভিনয়ের জায়গাটা যেমন বহুমাত্রিক রূপ পাবে, দুই শিল্পের যন্ত্রনার বিনিময়ে,মিলমিশে শিল্পজগৎ অনেকটা সমৃদ্ধ হবে।
‘নোনা পানি ‘ চলচ্চিত্রে সুর এবং গানের ব্যবহার খুবই ভালো। নোনা পানির জনজীবন নিয়ে চলচ্চিত্র, চারপাশে এত জল আর জল অথচ বৃদ্ধের গলা শুকিয়ে আসে,কলসে একফোঁটা পানীয় জল থাকে নাl মানুষের এই জীবন শূন্যতা, হাহাকার এই চলচ্চিত্রের মূল ভাষা। পরিচালক নিগার এই আর্তনাদের ভাষাকে তুলে আনতে পেরেছেন। বুকের ভেতর একটা যন্ত্রনা চারিয়ে দিয়েছেন।
একজন মহিলা (যেহেতু সামাজিক অসাম্য এখনো হঠেনি) পরিচালক প্রথম ছবিতেই যে এভাবে জীবনের স্রোতগুলোকে মেলে ধরতে পারেন, স্রোতের বাঁকে বাঁকে প্রতিস্পর্ধী দাগ রেখে যেতে পারেন তাও কম প্রতিপাদ্য নয় । এই বিশ্বায়নের প্রতিযোগীতার দুনিয়ায় আঞ্চলিক ভাষা, আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্য সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও এ ধরণের চলচ্চিত্র দরকার।