Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পিরিয়ডকালীন অস্বস্তি দূর হবে কবে

ঋতুচক্র বা পিরিয়ড নারীজীবনে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সামাজিক সচেতনতার অভাবে এই স্বাভাবিক ঘটনাকেই দেখা হয় অস্বাভাবিকভাবে। পিরিয়ড বর্তমানেও একটি ট্যাবু হিসেবে রয়েছে। একমাত্র সবার সচেতনতাই পারে এই ট্যাবু ভাঙতে। পিরিয়ড ট্যাবু ভাঙার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস আমাদের আজকের এই প্রতিবেদন।

পিরিয়ড কী
১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে মেয়েদের ঋতুচক্র শুরু হয়। বেশিরভাগ নারী প্রতি মাসের ২৮ তারিখের ৭ দিন আগে অথবা ৭ দিন পরে ঋতুস্রাবের মুখোমুখি হয়। প্রতি চন্দ্র মাস পর পর হরমোনের প্রভাবে পরিণত মেয়েদের জরায়ু চক্রাকারে যে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় এবং রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত অংশ যোনিপথে বের হয়ে আসে, তাকেই পিরিয়ড বা ঋতুচক্র বলে।

কেন হয় পিরিয়ড
পিরিয়ড বা মাসিক বা ঋতুস্রাব যেই নামেই ডাকুন না কেন, প্রাকৃতিক নিয়মেই মেয়েদের প্রজনন প্রক্রিয়ায় প্রভাবকারী একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বলতে গেলে একটু ভেঙে বলতে হবে। মেয়েদের প্রজনন তন্ত্র দুটি প্রধান অংশের সমন্বয়ে গঠিত। প্রথমত, জরায়ু, যেখানে ফিটাস বিকশিত হয় এবং পুরুষের শুক্রাণু ফেলোপিয়ান নালিতে পরিবহণ করে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় প্রধান অংশ হচ্ছে ডিম্বাশয়, যা ডিম্বাণু উৎপন্ন করে। মাসিক চক্রের সময় শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়।

এই হরমোনে আছে এসট্রোজেন এবং প্রজেসটেরোন যা শরীরকে গর্ভবস্থার জন্য তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণত, প্রতি ২৮ দিন পরপর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়, যা জরায়ুর দুই পাশের ফেলোপিয়ান নালী দিয়ে জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে। গর্ভধারণ না করলে, অনিষিক্ত ডিম্বাণু এবং জরায়ুর আবরণ একত্রে প্রত্যেক চক্রে শরীর থেকে ঝরে যায়। একেই পিরিয়ড বা মাসিক বলা হয়। যারা এতসব কঠিন কথা বুঝতে রাজি না তাদের জন্য এক কথায় বলি মাসিক হলো এমনই একটি ন্যাচারাল প্রক্রিয়া যেটা না থাকলে আপনার, আমার জন্মই হত না।

মেন্সট্রুয়াল সাইকেল সম্পর্কে ধারণা
মেন্সট্রুয়াল সাইকেল কিভাবে চলতে থাকে জানা আছে কী? তিনটি অংশে এই সাইকেলকে ভাগ করা হয়, প্রথমটি গড়ে চারদিন স্থায়ী হয় (৪-৭ দিন) এবং একে মিনস্ট্রাল ফেজ, দ্বিতীয়টি ১০ দিন (৮-১০ দিন) একে প্রলিফারেটিভ ফেজ এবং তৃতীয়টি ১৪ দিন (১০-১৪ দিন) স্থায়ী হয় একে সেক্রেটরি ফেজ বলা হয়। মিনস্ট্রাল ফেজে ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোনের যৌথ ক্রিয়ায় যোনি পথে রক্ত বের হয়, যেটাকে আমরা পিরিয়ড বলি।

প্রলিফারেটিভ ফেজে শুধু ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে জরায়ু নিষিক্ত ডিম্বাণুকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্ততি নেয়। সেক্রেটরি ফেজ ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন উভয় হরমোনের যৌথ কারণে হয়। এই সময় নিষিক্ত ডিম্বাণুর বৃদ্ধির জন্য জরায়ু সর্বোচ্চ প্রস্ততি নিয়ে থাকে আর এটা না হলে আবার মেন্সট্রুয়াল ফেজে চলে যায়। এভাবেই পূর্ণ বয়স্ক মেয়েদের ঋতুচক্র চলতে থাকে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত। মাসিক হওয়ার পরে মেয়েরা প্রজননক্ষম মানে সন্তান ধারণের ক্ষমতা লাভ করা।

তবে এই সাইকেলটা কতদিন চলতে থাকে জানেন কি? সাধারণত ০৯-১৩ বছর বয়সে যে কোন সময় মাসিক শুরু হয় এবং ৪৫-৪৯ বছর বয়সে স্বাভাবিক নিয়মেই মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েদের প্রতি ২৪ থেকে ৩২ দিন অর্থাৎ গড়ে ২৮ দিন পর পর মাসিক হয়।

পিরিয়ড ট্যাবু ও আমাদের সমাজ
‘কী দিন আসলো, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সবার সামনেই পুরুষের হাত থেকে প্যাড কিনছে!
‘বাইরে যাবি না কেন? কিরে, হইছে নাকি!’
‘টয়লেটে এত সময়…কী মাসিক হইছে!’

এমন অনেক কথাই মেয়েদের শুনতে হয়। মিলিয়ে নিন তো আপনার সঙ্গে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না, বা আপনি নিজে কখনো এমন আচরণ করেছেন কি না! চুপচাপ কাউকে বসে থাকতে দেখলে বা বাইরে বের হতে না চাইলে, ওয়াশ রুমে গিয়ে একটু বেশি সময় নিলে বা কোনো মেয়েকে ফার্মেসি থেকে প্যাড কিনতে দেখলেই কানাঘুষা শুরু, সঙ্গে মুখ টিপে হাসাতো আছেই। এমন অনেক ঘটনা আমাদের আশেপাশেই কিন্তু হচ্ছে। ট্যাবু নিয়ে যেহেতু কথা বলছি, আমি নিজের অভিজ্ঞতা আর আশেপাশের ঘটনা থেকে কিছু উদাহরণ দিলাম আর কী। পৃথিবীর সব নারীকেই তো এই প্রাকৃতিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাহলে এটা নিয়ে কেন মজা নিতে হবে? আর এসব কারণে অনেক মেয়েরা তাদের সমস্যার কথা শেয়ার করতে লজ্জা পায় কিন্তু পিরিয়ড সংক্রান্ত সমস্যা লুকিয়ে রাখলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। বিব্রত হওয়ার ভয়ে স্কুলগামী কিশোরীরা স্কুলে যেতে চায় না পিরিয়ডের সময়। একটা স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে উভয় পক্ষের এত গোপনীয়তা, সংকোচ কিংবা ঠাট্টার মনোভাব কেন? যারা এমনটা করেন বা করেছেন নিজেকে একবার প্রশ্ন করে দেখুন তো!

অনেক বাবা-মাকেই দেখেছি পিরিয়ডের বিষয়ে সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তিতে পড়েন। টিভিতে পিরিয়ড সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন এলে তা চট করে সরিয়ে ফেলার অভ্যাসটাও তৈরি হয়ে গেছে আমাদের। আমরা মেয়েরাও কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট লুকোচুরি করি। কোনো সমস্যা হলেও ডাক্তারের কাছে যেতে লজ্জা পায়। হাইজিন নিয়েও সচেতনতার অভাব আছে। পিরিয়ড নিয়ে কিছু বিষয় ছেলে মেয়ে সবারই জানা উচিত। ট্যাবু ভাঙার বিষয়টা নিজের ঘর থেকেই শুরু করুন।

পিরিয়ড ট্যাবু কিভাবে ভাঙতে পারি
আমাদের দেশে পিরিয়ড নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হচ্ছে সচেতনতা কার্যক্রম। পরিবারের সুরক্ষার ভার যেমন আপনাকেই নিতে হবে, তেমনি সামাজিক কুসংস্কার দূর করারও উদ্যোগটা নিতে হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। এটা ঠিক যে রাতারাতি আপনি সমাজ বদলাতে পারবেন না, কিন্তু আস্তে আস্তে সবাইকে যদি এই ব্যাপারে আমরা সচেতন করতে পারি তাহলে সুদিন আসতে খুব বেশি দেরি হবে না। তবে চলুন দেখে নেই কিভাবে পিরিয়ড ট্যাবু ভাঙতে পারি!

পিরিয়ড ট্যাবু ভাঙার পদক্ষেপগুলো
পিরিয়ডে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা
গ্রাম অঞ্চলে এখনো পিরিয়ডে কাপড় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পিরিয়ডে সর্বাধিক হাইজিন মেনে চলতে হবে। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হবে। আর ন্যাপকিন লুকিয়ে কেনার মতো বিষয় না। তাই লজ্জা না পেয়ে ডিসপেনসারি থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে ব্যবহার করতে হবে।

স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন করা
যেহেতু পিরিয়ডের সময় হাইজিন মানা জরুরি, তাই ৪-৬ ঘণ্টা পরপর প্যাড পরিবর্তন করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পরপর প্যাড পরিবর্তন না করলে জরায়ু সমস্যা থেকে শুরু করে অনেক সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে।

সন্তানের সাথে পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা কথা বলা
সন্তান প্রশ্ন করার আগেই তার সঙ্গে কথা বলুন বয়ঃসন্ধিকাল কী, পিরিয়ড কখন এবং কেন হয়, কী কী সতর্কতা মেনে চলতে হয় ইত্যাদি। তাহলে তার যখন প্রথম পিরিয়ড হবে, তখন সে ঘাবড়ে যাবে না। সমাজকে আপনি একদিনে পাল্টাতে পারবেন না। তাই মেয়ে সন্তানের মেন্টাল স্ট্রেন্থ-এর দিকেও নজর দিন। আশেপাশের কটু কথায় সে যেন মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে সেভাবেই তাকে প্রস্তুত করুন। তবে কথা বলার আগে লক্ষ্য রাখবেন আপনার সন্তান এই কথাগুলো একসেপ্ট করার মতন ম্যাচিউরড হয়েছে কিনা।

পিরিয়ড নিয়ে স্কুলে সচেতন করা
পিরিয়ডের সময়ে স্কুলগামী মেয়েরা যাতে ক্লাসে অনুপস্থিত না থাকে এবং তাদের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে যেন কোনো আপোষ না করতে হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে বাবা-মা আর শিক্ষক-শিক্ষিকাকে। নিজেকে কিভাবে সে পরিচ্ছন্ন রাখবে, সেটাও আগে জানিয়ে দিন। স্যানিটারি ন্যাপকিনের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করাটা এখন সময়ের দাবি। স্কুলগামী কিশোরীদের সচেতন করতে ইতিমধ্যে অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, সরকারিভাবেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

মাসিক নিয়ে তিরস্কার নয়
‘পিরিয়ড’ ব্যাপারটা নিয়ে পুরুষদের মাঝে অনেকেরই তাচ্ছিল্য টাইপের মানসিকতা দেখা যায় যেটা অবশ্যই পরিহার করা উচিৎ। কিশোর বয়স থেকে যদি ছেলেদের কাছে এটা নিষিদ্ধ জ্ঞান হিসেবে আবির্ভূত হয় তাহলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই মানুষগুলোর আচরণ অসংবেদনশীল হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু না। তাই ভাইও চাইলে বোনের জন্য প্যাড কিনতে পারেন। এই স্বাভাবিক ঘটনাটা সহজ ভাষায় তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে। স্কুলের শিক্ষক, মা, বড় বোন এই দায়িত্বটা পালন করবেন।
পিরিয়ড কোনো রোগ বা লজ্জার বিষয় নয়। আমাদের মানসিকতা পাল্টালে সমাজও বদলে যাবে। এই বিষয়ে অহেতুক মজা নেওয়ার আগে একবার ভাববেন এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া না চললে কেউই পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে পেত না। শেষে একটা কথাই বলতে চাই, জানুন, বুঝুন এবং নিজের মানসিকতা পরিবর্তন করুন। পিরিয়ড নিয়ে মনের দীনতা দূর করুন আজই।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ