পোশাক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যা বললেন
পোশাক কখনো কারো পরিচয় বহন করে না বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে কেমন তা কখনো পোশাক দেখে বুঝে ওঠা যায় না। পোশাক মানুষের স্বভাবের পরিচয় নির্ধারণ করে না। অর্থাৎ আমরা শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রেস কিংবা কলেজ ড্রেস দেখে বলতে পারি, তারা কোন স্কুল বা কলেজের শিক্ষার্থী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট পোশাক না না থাকায় কে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তা ওপর থেকে দেখে বুঝে ওঠা যায় না। পোশাক পরার স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের আছে। তাই সে কী রকম পোশাক, পরবে তা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
সম্প্রতি নারীর পোশাক নিয়ে উঠেছে নানান কথা। টিপ কান্ডের পর এবার কথা উঠেছে নারীর পোশাক নিয়ে। স্বাধীন দেশে বসবাস করায় দেশের প্রতিটি মানুষের নিজের পোশাক কেমন হবে, তা নির্ধারণ করার অধিকার রয়েছে। ছেলেরা যেমন নিজের পোশাক নিজে নির্ধারণ করে থাকে, একইভাবে নারীরাও করে থাকে। কিন্তু কখনো কি ছেলেদের পোশাক নিয়ে কথা ভাসতে দেখা গেছে? তবে নারীর ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন। নারীর পদে পদে দোষ খোঁজা হয়। তাই তার পোশাকটা কী রকম, সেটি নিয়েও কথা হয়। নারীর পোশাক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতবাদ প্রকাশ করেন।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া কায়সার শার্লি নারীর পোশাক সম্পর্কে বলেন, ‘কথায় আছে নারী শাড়িতেই সুন্দর। কিন্তু তাই বলে কি বাস্তব জীবনে সবসময় শাড়ি পরা সম্ভব? আমি একজন শিক্ষার্থী। আমার যখন প্রয়োজন হয় কিংবা ইচ্ছে করে আমি শাড়ি পরি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আমি শাড়ি পরি না। পোশাক হিসেবে আমি ওয়েস্টার্ন যেমন পরি, ঠিক সেভাবে ক্যাজুয়াল কিংবা দেশীয় পোশাকও পরি। একজন নারী হিসেবে আমার পোশাক সিলেক্ট করার অধিকার রয়েছে। তাই সেই অধিকারবোধ থেকেই আমার যখন যে রকম পোশাক পরতে ইচ্ছে করে কিংবা প্রয়োজন হয়; তখন সে রকম পোশাকই পরি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি নারীর পোশাক নিয়ে নানান কথা উঠেছে। কিন্তু কখনো শুনলাম না কোনো পুরুষের পোশাক নিয়ে কথা উঠতে। আমার পোশাক নিয়ে অনেকেই হয়তো অনেক কমেন্ট করে থাকে কিন্তু কখনো আমার পাশে থাকা ছেলে বন্ধুটির পোশাক নিয়ে তো কেউ কথা বলে না। আসলে মূল বিষয়টি হলো দৃষ্টিভঙ্গির। আমি সালোয়ার-কামিজ পরি। তার মানে আমি সভ্য। আমি ওয়েস্টার্ন পরি। তার মানে আমি অসভ্য। বিষয়টি মূলত দৃষ্টিভঙ্গির। স্বাধীনতার এত বছর পরও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলো না। পোশাক কখনো কারও পরিচয় বহন করতে পারে না।’
নারীর পোশাক নিয়ে নিজের ভাবনা ব্যক্ত করতে গিয়ে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমনা আক্তার বলেন, ‘আমার বেড়ে উঠা গ্রামে। গ্রামীণ পরিবেশে বাচ্চাকাল থেকেই পোশাক নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর সবাই নিজের ইচ্ছে মতো পোশাক চুজ করে থাকে। ঠিক যেমন আমি আমার নিজের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরতে পছন্দ করি। ওয়েস্টার্ন ড্রেস খুব বেশি না পরলেও কামিজের সঙ্গে সেলোয়ারের বদলে জিন্স পরা হয়। যখন প্রথম প্রথম জিন্স পরা শুরু করি অনেকেই দেখে অনেক বক্তব্য দেয়। ধর্মীয় জ্ঞানও শুনতে হয়েছে অনেক। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও একটা সময় পর অভ্যস্ত হয়ে যাই। এখন আমার পোশাক নিয়ে কেউ কথা বললে তা আর গায়ে লাগে না। আমার মতো অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা পোশাক নিয়ে অন্যের কথা গায়ে লাগায় না। কিন্তু তাই বলে যে সবার পোশাক নিয়ে নিজে মতামত করে দিতে হবে এমনটা ঠিক না। পোশাক সবার নিজেদের বিষয় তাই এতে কারো হস্তক্ষেপ করা উচিত বলে আমার মনে হয় না।’
সানজিদা পারভিন অনন্যা অনন্যা স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী বলেন, ‘একজন নারী হিসেবে পোশাক নিয়ে অনেক সময়ই অনেক কথা শুনতে হয়েছে। শুধু যে আমাকে শুনতে হয়েছে, এমনটা না। আমার বাবা-মাকেও শুনতে হয়েছে। পর্দা করা নিয়েও প্রায় সময় কথা শুনতে হয়েছে। পর্দা কি কখনো জোর করে করানো সম্ভব? আমার যদি ইচ্ছে হয় আমি নিজেই পর্দা করবো। কারও আমাকে বলে দিতে হবে না। কিন্তু পেছন থেকে যখন কেউ বলে, তখন অনেক খারাপ লাগে। বর্তমান সময়ে পোশাক নিয়ে কথা উঠলে সেটা শুধু নারীর পোশাক নিয়েই ওঠে। আজ অবধি শুনলাম না কোনো ছেলের পোশাক নিয়ে কেউ বাজে কমেন্টস করেছে। কিন্তু মেয়েরা মায়ের জাত, তাই সবসময় মেয়েদের পোশাক নিয়েই কথা ওঠে। একটা সময় তো পোশাক নিয়ে একটা মেয়ের পারিবারিক শিক্ষা নিয়েও কথা উঠে যায়। এটা কি ঠিক? পোশাকই কি সব? মাঝেমাঝে খারাপ কমেন্ট করা ব্যক্তিদের এই প্রশ্নগুলো করতে খুব ইচ্ছে করে। মেয়েদের স্বাধীনতা দিয়েছে বলে থাকে অথচ মেয়ের পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই তো মেয়েদের স্বাধীনতা।’
নারীর পোশাক সম্পর্কে মৌমিতা পাল রংপুর কারমাইকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, ‘পোশাক নিজ ইচ্ছেমতো পরা নারী-পুরুষ সবার অধিকার। এই অধিকার যে শুধু পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, নারীদের ক্ষেত্রে হবে না, তা নয়। নারী-পুরুষ সবারই সমান অধিকার। কিন্তু পোশাক নিয়ে কথা তুললে সবসময় নারীর পোশাক নিয়েই কথা তোলা হয়। সুশীল সমাজের ব্যক্তিগণই এই ভেদভেদটা বেশি করেন। নারী তাদের ইচ্ছেমতো চলতে না পারলে নারী ভালো না। আর এই ভালো মন্দের মাপকাঠিটা বেশিরভাগ সময়ই পোশাকের ওপর নির্ভর করে। বাঙালি স্বাধীন দেশ পেলেও আজ অবধি নিজের স্বাধীনতা পায়নি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও আমি স্বাধীনভাবে চলতে ফিরতে পারি না। নিজ ইচ্ছে অনুযায়ী পোশাক পরতে পারি না, অন্যের খারাপ কথা সহ্য করতে হয়। এত সব কিছু মিলিয়ে তাহলে আমি কিভাবে টিকে থাকবো এই দেশে?’
অনন্যা/এসএএস