জোর যার মুল্লুক তাঁর!
প্রচলিত সামাজিক প্যারেন্টিং অনুযায়ী, ছেলে ও মেয়েকে বড় করে তোলার দীর্ঘ পথে কিছু ভাগাভাগি পূর্বনির্ধারিত করা আছে। যেমন ছেলে মানে নীল, ছেলেদের রাগ হবে বেশী, ছেলেরা রান্না ঘরে যাবে না, ছেলেদের গলার আওয়াজ হবে জোরালো, ছেলেদের আউটগোয়িং হতে হবে ইত্যাদি। অপরদিকে মেয়েদের হতে হবে ধৈর্যশীল, আত্মত্যাগী। মাতৃত্ব আর কারো সহধর্মিণী হওয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, মুখে মুখে কথা বলা যাবে না, গলার আওয়াজ হবে ক্ষীণ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সকল ছোট ছোট বিষয়বস্তুকে বিশেষ রঞ্জিত করার ফলেই, জোর যার বেশী সে মুল্লুক টা পেয়ে যায়।
তবে জোরের উপর প্যারামিটার তৈরি করা টা কতটুকু ফলপ্রসূ সেটা নজর আন্দাজ করাটা দরকারী নয় কি?
যেহেতু পুরুষ ও নারীর মধ্যে পুরুষ শারীরিকভাবে বলবান গড়নের হয়, সেহেতু সবাই পুরুষ কে সমাজ সীমান্ত রক্ষাকারী হাতির ন্যায় সম্মান দিয়ে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু বলবান শরীর আর ঝমঝম আওয়াজেই কি জোরালো শাসক নির্ধারণ করা যায়? শাসক নির্ধারিত হওয়া উচিত বুদ্ধিবৃত্তি ও রণকৌশলের উপর ভিত্তি করে। এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে রণকৌশলে পারদর্শী হতে হলে তো বলবান হতে হয়। এখানে একটা রূপক গল্পের উদাহরণ টেনে নিয়ে আসা যেতে পারে। বুদ্ধিমান শেয়াল আর বোকা বাঘের গল্প নিশ্চয়ই মনে আছে। যদিও এ গল্পের উদাহরণ দেয়ার উদ্দেশ্য দুপক্ষের প্রতি সাংঘর্ষিক মনোভাব প্রকাশ করা নয়। সকল গল্প, প্রবন্ধ বা নারীবান্ধব যেকোনো পটভূমি টেনে আনার উদ্দেশ্যেই হচ্ছে নারী কে মানুষ বলে বিবেচনা করার কথাটা বার বার মনে করিয়ে দেয়া।
প্যারেন্টিং এর কবলে পড়ে জোরের মুল্লুক ভাগাভাগির করার কথায় ফিরে আসা যাক। নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতাই হোক আর নারীকে যৌন নির্যাতন করাই হোক। সবখানেই এই জোরের আধিপত্য বিরাজ করে। যৌন হয়রানির অবাধ প্রচলন নারীর প্রতি যৌন আকর্ষণ বলে মনে হয় না। বরং ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, অযাচিত যৌনাচার একতা ক্ষমতার মেলবন্ধন ই বেশি। নারীকে রেখে ঢেকে চলতে হবে, নারীর পর্দা করা বাধ্যতামূলক, নারীরা হলেন একটা প্যাকেট উপড়ানো ললিপপ এর মত। এই ধরণের মন্তব্যগুলো নারীদের উপর ক্ষমতা প্রভাবের আগ্রাসন আরো বেশি করে জোরালো করে। একজন বলবান পুরুষ চাইলেই নারীকে শুধুমাত্র তাঁর কথা মত না চলার কারণে উত্তম মধ্যম দিয়ে কাবু করে ফেলতে পারে। কয়েকজন বলবান পুরুষ চাইলেই রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে থাকা নারী কে ধর্ষণ করে ফেলতে পারে। এর কারণগুলো তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্ষমতার তাগিদেই। কাজেই ক্ষমতার জোরে মুল্লুক দখল করে নেয়াটা একটা স্বাভাবিক ঘটনাই এ সমাজে ।
এই আধুনিক যুগেও নারীরা ক্ষমতার পরোয়ানায় নিপীড়িত। এবং এই নিপীড়নেরর পৃষ্ঠপোষকেরা এ সমাজের ই মানুষ। ঘরে, বাইরে, মন্দির, মসজিদ, কর্মস্থল কোথায় নেই এই পৃষ্ঠপোষকেরা? তাই ধর্ষণকে কেবল জৈবিক না, বরং সামাজিক কারণ হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। এছাড়াও আনাচে কানাচে নারীর প্রতি সকল সহিংসতা কে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই আরো বেশী করে বাহবা দিচ্ছে। ২০২০ সালে ৩৬৫ দিনেই ১৩৪৬ টি ধর্ষণের কেইস সম্পর্কে জানিয়েছে মহিলা পরিষদ। বিলক্ষণ লিখিত রিপোর্টের বাইরে আরো ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। না জানি কতগুলো অলিখিত রিপোর্ট জোরের থাবায়ই পিষে গেছে।