নারীর সৌন্দর্য গায়ের রঙে নয়, প্রজ্ঞায়
আবহমানকাল ধরে বাঙালির সাধারণ ধারণা, নারীর গায়ের রঙই তার সৌন্দর্যের প্রকাশ! কিন্তু নারীর সৌন্দর্য কেন গায়ের রঙ হবে, তা নিয়ে তেমন করে অতীতে কেউ প্রশ্ন তোলেনি? বর্তমানে জ্ঞানপিপাসু, আত্মসচেতন নারী ও নারীবাদীরা বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলছেন। তাদের মতে, যদি ধর্মীয় দিক বিবেচনা করা হয়, তবে তো এটাই আগে স্বীকার করা উচিত, স্রষ্টার সব সৃষ্টিই সুন্দর। সেখানে মানবজাতিকে যেকোনো পরিস্থিতিতে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের কোনো ব্যাপার থাকতে পারে না। তবে সবক্ষেত্রে ধর্মের দোহাই দিলেও নারীর রূপের ক্ষেত্রে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ বা ‘প্রকৃতির দান’ বা ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকটি’ বরাবরই অস্বীকার করে পুরুষতন্ত্র।
নারীর প্রজ্ঞা-রূপের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে তার প্রকৃত সৌন্দর্য। সেখানে রূপ বলতে যে শুধু গায়ের রঙ বোঝাবে, ব্যাপারটা এমন নয়। গায়ের রঙ তো বাইরের আবরণ।
আমরা জানি, যাদের শরীরে ‘মেলানিন’ কম, তাদের গায়ের রঙ অন্যদের চেয়ে সাদা। যাকে আমরা ফর্সা বলে অভিহিত করি। এক্ষেত্রে মানুষের নিজের কোনো ক্ষমতা নেই। তবে মেয়েদের গায়ের রঙের কেন এত কদর! কেন পরিবারে একটি মেয়ে সন্তান অপেক্ষাকৃত কম ফর্সা হলে তার দিকে সবাই ভ্রূ কুঁচকে তাকায়! কেন বাবা-মায়ের হাইপার টেনশন শুরু হয়, যখন মেয়ে সন্তান জন্মের পর তার গায়ের রঙ চাপা মনে হয়! দেশের নিরানব্বই ভাগ বাবা-মা ছেলের জন্য যখন পাত্রীর সন্ধান করেন, তখন প্রথম যোগ্যতা পাত্রীর গায়ের রঙ! কী আশ্চর্য সমাজব্যবস্থা! যার জন্য ব্যক্তির নিজের কোনো দায় বা কৃতিত্ব কোনোটাই নেই, সেটাই কনের যোগ্যতা হয়ে উঠলো! এই মানসিকতায় বর্তমান নারী সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
নারীরা সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বেছে নিচ্ছে বিকল্প পথ। যে পথে নারীদের জন্য রয়েছে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি! সৌন্দর্যের মূল কথা গায়ের রঙ; এমন মানসিকতার কারণে তারা ত্বক ফর্সাকারী বিভিন্ন প্রসাধনী ব্যবহার করছে। যা তার ত্বককে ফর্সা করবে, এমনটাই ধারণা। ফল হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তিনদিন বা এক সপ্তাহে গায়ের রঙ ফর্সা হবে। নারীরা সামাজিকভাবে বিভিন্ন রকম হেনস্তার শিকারের পরিত্রাণ ঘটাতে, অন্যদের কাছে নিজেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলতে, এই ধরনের পণ্যগুলো ব্যবহার করছে। যেগুলো বাইরের বিভিন্ন দেশ যেমন পাকিস্তান, চায়না, কোরিয়া, থাইল্যান্ড থেকে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। এছাড়া নারীদের মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত দামেও বিক্রি করা হচ্ছে! এ ধরনের মানসিকতার কারণে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে তাদের!
এই রঙ ফর্সাকারী ক্রিমগুলোতে মার্কারি, টাইটিয়ান ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অতিরিক্ত মাত্রায় দেখা যাচ্ছে! ফলে সাময়িক সৌন্দর্যের কথা ভেবে নারীরা নিজের জীবনকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে! এতে ধীরে ধীরে ত্বকে ক্যানসার সৃষ্টি, ব্লাড ক্যানসার, নার্ভ সিস্টেম ড্যামেজ, কিডনি সমস্যা, ব্রেনে নানা ধরনের জটিলতাসহ নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত রোগের সৃষ্টি হচ্ছে!
নারীর সৌন্দর্য কখনোই গায়ের রঙে না। এটা প্রথমে নারীকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। গায়ের রঙ সাদা হলেই যদি সুন্দর হয়, তাহলে, তাহলে আফ্রিকান বা নাইজেরিয়ানরা কি সুন্দর নয়? ব্যাপারটা মানসিকতার। নারীর সৌন্দর্য তার প্রজ্ঞায়-জ্ঞানে-বুদ্ধিতে। সেখানে গায়ের রঙ গৌণ। কিন্তু গৌণ বিষয় নিয়ে বাঙালি জাতির চিরন্তন মাথাব্যথা! তাই মুখ্য বিষয়গুলোকে তারা দেখেই না! নারী তার আপন সত্তাকে প্রজ্বলিত করবে জ্ঞানের দ্বারা, চারিত্রিক সৌন্দর্য ও বৃদ্ধির মাধ্যমে। সেখানে শুধু ত্বকের রঙের পরিবর্তন মোটেও জরুরি নয়।
প্রথমেই বলেছি, এক্ষেত্রে নারীকে নিজের আত্মিকশক্তির মূল্যায়ন করা শিখতে হবে। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন কোনোদিন হবে না, যদি তারাই সমাজের এই ধরনের মানসিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে থাকে! সম্মান তখনই পাওয়া যায়, যখন ব্যক্তি নিজেকে মূল্যায়ন করতে জানে। তাই নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির দায়িত্ব তার নিজের। তবে সেটা গায়ের রঙে নয়! বরং জ্ঞানচর্চায়। চারিত্রিক সৌন্দর্য পরিচর্যার মাধ্যমে, মানবিকতার মাধ্যমে, সরলতার-সহনশীলতার চর্চার মাধ্যমে। নারীকে জেগে ঘুমালে চলবে না; বরং সমাজের অনিময়- অপশাসনের মূলে কুঠারাঘাত করতে হবে। নিজের জীবনকে সুশৃঙ্খল করে গড়ে তোলার মানসই নারীর সৌন্দর্য। ফলে নারীকেই নিজশক্তি বৃদ্ধিতে সততা-প্রজ্ঞার সঙ্গে পরিশ্রম করতে হবে। তবেই একদিন পৃথিবী থেকে দূর হবে সমস্ত অমানবিকতা, সৌন্দর্যচর্চার নামে বর্বরতা।
অনন্যা/এআই