Skip to content

৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ১৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীকে সাবেক স্বামীর হয়রানি: বন্ধ হোক এই বিকৃতি

আমাদের সমাজব্যবস্থা এমন একটা ঘোরটোপে বাঁধা, যেখানে প্রকৃত মূল্যবোধ ও বিবেকের চর্চা নেই। মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলে, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করলেই যে সত্যিকার মানব সন্তান হয়ে ওঠা যায় না, সে নজির এই সমাজে অসংখ্য। বর্তমান সময়ে পুঁথিগত বিদ্যার জোরে অনেকেই তরতরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মনের দিক থেকে অর্থাৎ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারছে না।

একজন আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী হওয়া। মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে মূল্যায়ন করা। যোগ্যতা, দক্ষতা; সর্বোপরি জ্ঞানের কদর করা। তবে এ সমাজ এতটাই পচা যে, এখানের শিক্ষিত, রুচিসম্মত মানুষের নামে সব আর্বজনায় ভরা। অন্যের খুঁত বা দুর্বলতাকে নিয়ে তারা কটূকথা বলতে, মজা করতে পছন্দ করে। আর কানকথা বা সামনে-পেছনে নানারকম মন্তব্য করতেও এই জাতি পটু।

এই সমাজের ঘুণেধরা মানসিকতার শিকার যিনি, তিনি বোঝেন, কোন সমাজে আমাদের স্থান! শুধু বিবেকসম্পন্ন প্রকৃত জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষের নাভিমূল থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস নেওয়া ছাড়া যেন কোনোই কিছু আশা করার নেই আর। তবে এ সমাজের ভাগ্যের এই অশনি দশা কি আদৌ কখনোই কাটবে না? নাকি এই সমাজের আবহমানকাল ধরে যে ধরনের বদ্ধমূল সংস্কার বা প্রথার নামে অপচর্চা চলছে তা থেকেই যাবে? তাহলে কেনই বা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ আর কেনই বা আধুনিক তকমায় নিজেদের অতি সভ্য জাতি বলে চিৎকার করা! একজন মানুষ যেখানে জীবনের সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেও দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অন্যের ক্ষতি করা বা অন্যকে অপদস্ত করার জন্য মুখিয়ে থাকে, তখন এই ধরনের লোক দেখানো ডিগ্রি কীই-বা দরকার! শুধু চাকরি, সামজিক স্ট্যাটাস বাড়াতে গিয়ে শিক্ষার অমর্যাদা সর্বোপরি মানব জাতির বিবেককে বিকিয়ে দিচ্ছে এ জাতির অধিকাংশই।

বিয়ে একটি সামাজিক স্বীকৃতি। দুজন মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান; সর্বোপরি মনের পারস্পরিক একাত্মতায় গড়ে ওঠে একটি সুস্থ, সুন্দর, স্বাস্থ্যবান সম্পর্ক। কিন্তু সেই সম্পর্কে যদি ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে ওঠে বা একজন ব্যক্তি অপরজনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে থাকে, অবজ্ঞা, অবহেলা করতে থাকে; তবে সে সম্পর্কে আর ভালোবাসা, বিশ্বাস্ততা, কিছুই থাকে না। থাকে শুধু সম্পর্কের একটি বোঝা বয়ে বেড়ানোর দায়! যে দায় শুধু লোক দেখানো বা সামাজিক সম্মানকে রক্ষা করার অতি গুরু দায়িত্ব। কিন্তু যেখানে ভালোবাসা, মর্যাদা ও বিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও রক্ষিত হয় না; সেই সম্পর্কের কী নাম দেওয়া যায়! একটি কাগজের গলগ্রহ। যাকে বলে সামজিক স্বীকৃতি। কিন্তু সবকিছু যখন ধ্বংস হয়, জরাজীর্ণ স্তূপে পরিণত হয়; তখনই মানুষ আলাদা হয়। যার নাম এ সমাজে ডিভোর্স।

মজার ব্যাপার হলো; এ সমাজ-সংসার তথাপি পরিপার্শ্ব কোনোভাবেই চায় না ডিভোর্সের মতো ঘটনা ঘটুক। এমনকি ভুক্তভোগী পাত্র-পাত্রীও এই যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসতে কুণ্ঠিত হয়। তবে কি সত্যি এ সমাজের কিছু আসে যায়, যখন কেউ একজন খুন হচ্ছে বা আত্মহত্যা করেছে? তখন কোথায় থাকছে তারা? কোথায় মুখ লুকিয়ে চুপটি করে থাকছে এ সমাজের কদর্য মানসিকতার মানুষজন? মৃত্যু তাদের কামনা, আকাঙ্ক্ষা যখন পূরণ করে তাদের কটুকথার গায়ে লবণের ছিটিয়ে দিচ্ছে, তবু তাদের বেঘোর ঘুম ভাঙছে না। কিন্তু এই দম্পতির যখন ডিভোর্স নিয়ে দুজনের দুটি পথকে নতুনভাবে রাঙাতে শুরু করে তখন একদল মূর্খ, অপোগণ্ড, বেহেড মাতালের দল আঙুল তুলে ঠিকই বলতে শুরু করে কী করলি জীবনে? এই তো ডিভোর্সের কালি গায়ে লাগিয়ে বসে।

সে যাই হোক কথা হলো, এই শ্রেণির আবার বিশেষভাবে একটি দোষে দুষ্ট। তারা সাবেক স্বামীর ছবি দিয়ে নারীকে হেনস্তা করে। নারীকে খুঁচিয়ে বোঝাতে চায়, আসলেই সে তার যোগ্য ছিল না বা সেই (স্বামী) তার যোগ্য ছিল না। এ শ্রেণি আবার সুযোগ পেলে নারীর কাছ ঘেঁষতেও দ্বিধা করে না। প্রেম নিবেদন, উত্যক্ত করার মতো অসংখ্য ঘটনা, রটনা; সবটাই তাদের দখলে থাকে। পৃথিবীর ইতিহাস নতুন নয়। কিন্তু সেই আদি মানুষের বর্বর আচরণ যেন এই সমাজের গায়ে আজও লেগে আছে। তারা নারীকে ভোগ্যপণ্য মনে করে। নারীকে দেখলেই তাদের কামনা জেগে ওঠে। নারীর শরীর যেন শুধু পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্যই সৃষ্টি! কী আজব সেন্টিমেন্ট এ জাতির।

শুধু এই পুরুষতন্ত্রের দখলে ব্যক্তিস্বার্থ। আত্ম-অহমিকা, দম্ভ, লোভ, হিংস্রতা। যার ক্ষুরধার নখের আঘাতে রক্তাক্ত করে তোলে নারীর মনকে, শরীরকে। এই বিষাক্ত বিষবাষ্প থেকে যেদিন পরিত্রাণ পাবে এ সমাজ, সেদিন মানবিক বোধের উন্মেষ হবে। নারীকে দেখলেই কামনা জাগবে না। জিহ্বার লালা ঝরবে না। নারী হয়ে উঠবে সম্মানের, পবিত্রতার প্রতীক রূপে। পুরুষতন্ত্রের এমন কদর্য মানসিকতার ধ্বংস হোক। সাবেক স্বামীর ছবি দিয়ে নারীকে বশে আনা বা নারীকে পুরনো বেদনায় খোঁচা দিয়ে রক্তাক্ত করার মানসিকতা চিরতরে এ সমাজ থেকে বিদায় নিক।

সাবেক প্রেমিক হোক বা স্বামী হোক, এ নিয়ে নারীকে বিপর্যস্ত করা, বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকারে পরিণত করা স্রেফ একধরনের ভণ্ডামি। এই জাতি সবটা বোঝে, তার নিজের মতো করে। শুধু না বোঝার ভান করে থাকতেই তারা বেশি পছন্দ করে! আজব সমাজের বাসিন্দা আমরা। যেখানে নিজেদের যথেষ্ট কাজ না থাকায় অন্যের পেছনে টিকটিকিগিরি করতে পটু এরা। সবকিছুরে ঊর্ধ্বে উঠে একটি কথায় বিশেষভাবে প্রযোজ্য, যতদিন এ জাতির মধ্যে শিক্ষার প্রকৃত আলো না ছড়াবে, ততদিন অন্যের বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টি পরিত্যাগ করতে অক্ষম। তাই সত্যিকার অর্থেই পরিবার, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্রের উচিত প্রকৃত মানব সন্তান গঠন করা৷ কিছু আজব প্রাণী দিয়ে সমাজকে নষ্ট করে তোলার মানে হয় না। এ সমাজের মানসিকতা বদলাক৷ মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে শিখুক। ব্যক্তিস্বতন্ত্রতাকে মূল্যায়ন করতে শিখুক। গড়ে উঠুক সুস্থ পরিবেশ যে পরিবেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশুদ্ধ আলো-বাতাস পেয়ে বেড়ে উঠবে। জাতির কলঙ্ক মুক্ত করবে। অন্যের বিষয়ে অযথা কালক্ষেপণ করতে দ্বিধা করবে। সামজিক মূল্যায়নের চেয়ে ব্যক্তির মান, মর্যদা বড় হয়ে উঠবে। এ দেশ, জাতির ভাগ্য সেই দিনের আশায়।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ