কৃত্রিমতায় বিলুপ্ত প্রায় জোনাকির আলো!
"তোমরা কি ভাই নীল আকাশের তারা ?
আলোর পাখি নাম জোনাকি
জাগি রাতের বেলা,
নিজকে জ্বেলে এই আমাদের
ভালোবাসার খেলা।"
শৈশবের পাতায় জোনাকি পোকা যেন এক বিস্ময়কর স্মৃতি। রাতের আকাশের তারার মত মিটমিট আলোয় যেন আলোকিত হতো প্রাণ। বিশ্বের সব দেশেই তাদের দেখা মেলে রাতের অন্ধকারে বিন্দু বিন্দু আলোয়। জলচর অনেক প্রাণীর এমন আলো জ্বালানোর ক্ষমতা থাকলেও স্থলচর প্রাণীর মধ্যে জোনাকিই একমাত্র। রাতের প্রকৃতির এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যই ফুটিয়ে তুলতে পারে এই জোনাকি। আর আজ সেই জোনাকিরা এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।
বিজ্ঞানীদের মতে নগরায়নের ফলে দিনকে দিন বসত বাড়ি স্থাপিত হচ্ছে। হাড়িয়ে যাচ্ছে খোলা মাঠ ও সবুজ প্রকৃতি। সংকীর্ণ হচ্ছে এসব কীটপতঙ্গের বিচরণ ভূমি। এতে তাদের টিকে থাকাটাই যেন বেশ হুমকির পথে। প্রকৃতিও যেন আগলে রাখতে পারছে না আর। এভাবে নিরবচ্ছিন্ন নগরায়নের ফলে সামনে হয়তো আর এদের দেখা মেলাও কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
এছাড়াও মানুষ যেভাবে নির্বিচারে কীটনাশক ব্যবহার করছে ফসল কিংবা পোকা তাড়াতে তাতে অচিরেই হাড়িয়ে যেতে পারে এই চমৎকার কীট প্রজাতি। তন্মধ্যে মানবসৃষ্ট দূষণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে জোনাকির দুই হাজার প্রজাতিই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। আর রাতের আঁধারে আলো জ্বালা এ পতঙ্গের জন্য একটি বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃত্রিম আলো। বিজ্ঞান সাময়িকী বায়োসায়েন্স প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন তথ্যই তুলে ধরেছেন গবেষকরা।
গবেষক দলের প্রধান টাফটস ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক সারা লুইস সিএনএনকে বলেন, নগরায়নের প্রভাবে অনেক প্রাণী প্রজাতিই নিজেদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। ফলে তাদের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়ছে। এসব প্রাণীর মধ্যে বেশ কিছু প্রজাতির জোনাকিও আছে, যাদের জীবনচক্র পুরো করার জন্য আশপাশের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন মালয়েশিয়াতে এক প্রজাতির জোনাকি আছে, যারা প্রজনন ঘটনায় ম্যানগ্রোভ গাছগাছালির এলাকায়। কিন্তু পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির বাদাবনগুলো সব পাম তেলের কারখানা আর মাছের খামারে পরিণত হচ্ছে। ওই জোনাকি প্রজাতির টিকে থাকাই দায় হয়ে উঠেছে। জোনাকির জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হুমকি হয়ে উঠেছে রাতের বেলায় কৃত্রিম আলো। গত একশ বছরে নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার বেড়েছে গুণাত্মক হারে। আর এত আলোর অত্যাচারে জোনাকির বংশ বিস্তার করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে মজার বিষয় টা হচ্ছে জোনাকির পেটের নিচের অংশে যে আলো জ্বলতে নিভতে দেখা যায়। তার উৎস হল লুসিফারিন নামের এক ধরনের রাসায়নিক উপাদান। জোনাকির শরীরের এনজাইম লুসিফারেজের উপস্থিতিতে ওই লুসিফারিন অক্সিজেন, এটিপি আর ম্যাগনেশিয়াম আয়নের সঙ্গে মিশলেই জোনাকির দেহ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে।
এ রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে বলা হয় বায়োলুমিনেন্স। কতটা আলো কতক্ষণ ধরে জ্বলবে,তা নির্ভর করে কি পরিমাণ অক্সিজেন জোনাকির শরীর সরবরাহ করবে তার ওপর। এই আলোর সংকেতই হল জোনাকির প্রেমের ভাষা। প্রজাতির পুরুষেরা অপরপক্ষকে এই আলো জ্বেলেই সংকেত দেয়। মেয়রাও তাতে সাড়া দেয় ছন্দবদ্ধ আলোর সংকেতে। কিন্তু এই যোগাযোগের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ঘরবাড়ি, সড়কবাতি, বিলবোর্ডের উজ্জ্বল আলো।
নগরায়নের ফলে মানুষের প্রয়োজনীয় যে আলোর সৃষ্টি হয় তা আকাশে যে দ্যুতি তৈরি করে তার প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত পড়ে। এই দ্যুতি পূর্ণিমার আলোর চেয়েও প্রখর হয়। আর এই আলোর ফলে হারিয়ে যায় জোনাকির আলোর সংকেত। যেভাবে রাতের বেলা পৃথিবীর ২৩ শতাংশ জায়গা এই কৃত্রিম আলোয় আলোকিত থাকছে সেখানে জোনাকির আলো যেন প্রকৃতির বিলাসিতা। এই আলোক দূষণ এই যেন বড় বাধা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে তার প্রজনন ছন্দে।
অন্যভাবেও জোনাকির স্বাভাবিক জীবনচক্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মানুষ। জাপান, তাইওয়ান, মালয়েশিয়ার মত দেশে রাতের বেলা জোনাক পোকার মিটিমিটি আলোর খেলা দেখার বিষয়টি পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রতি বছর দুই লাখ পর্যটক এই জোনাক পর্যটনে অংশ নিচ্ছেন। তাতে জোনাকির জীবন আর স্বাভাবিক থাকছে না। সেসব এলাকায় জোনাকির সংখ্যাতেই এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখতে আজ যেন কোন আয়োজন নেই। শুধুই আছে লোকালয় আর কোলাহল। কোথা থেকে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে জোনাকি তার খবর কেউ রাখি না। এতসবের ভিড়েও তারা মিটমিট করা তারার মত জ্বালিয়ে রাখছে নিজেদের। তবে বাংলাদেশের শহরতলী কিংবা গ্রামগঞ্জের জোনাকির মেলা টিকিয়ে রাখতে আলোর দূষণ কমিয়ে আনা প্রয়োজন। অযথাই নিসর্গশোভার জায়গায় ভাগ না বসিয়ে তাদেরও বাঁচার সুযোগ করে দেয়া দরকার। আলো করুক প্রকৃতি, বেঁচে থাকুক জোনাকি।