Skip to content

৮ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যানার, পোস্টারেই নেতা বনে যাই!

নেতা হতে গেলে তার কি থাকা চাই? যদি বলি বড় বড় ব্যানার আর ফেস্টুনে সমালোচনাকে ঢেকে রাখা চাই; অবাক হবেন কি? উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির হালনাগাদ জানলে, আপনার এই শিরোনামে অবাক হওয়ার কথা নয়। ব্যানার- ফেস্টুনের এই সংস্কৃতি হঠাৎ করে উদয় হয়নি। এইরকম পরোক্ষভাবে সাধারণ জনগণকে মগজ ধোলাইয়ের চিন্তাটা আমার আপনার কাছ থেকেই জেঁকে বসেছে। তাই এর দায়ভার এড়াতে পারে না কেউ, মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা ছাড়া।

 

নেতৃত্ব একটি দক্ষতা, যা একটি সাধারণ উদ্দেশ্যকে সাধন করতে একটি দলকে প্রভাবিত করে থাকে; এবং যিনি নেতৃত্বের এই গুণকে ধারণ করে, সেই উদ্দেশ্যকে সাধন করেন, তিনিই নেতা। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে, একজন নেতা হওয়াটা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, বরং তাকে এ জন্য প্রচুর কাঠ খড়ি পোড়াতে হয়। ওই সাধারণ দলের কাজ হাসিলের জন্য যে সকল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়, তার ভুক্তভোগীর শিকার হোন নেতা। তাই, এমন একজন মানুষের অনুসারী, শুভাকাঙ্ক্ষী থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয়েও একটা 'কিন্তু' টেনে যাচ্ছি।

 

বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমাদের কাছে এমন একটা দৃশ্যায়ন ফুটে উঠেছে যে আমরা নেতার দক্ষতাকে ভুলে তার সামাজিক পরিচয়কে পুরোপুরিভাবে মূল্যায়ন করছি তার ব্যানার ও পোস্টারের উপর। ব্যাপারটা এমন যে, "বড় নেতা সে, ব্যানারে বড় যে"। অর্থাৎ, আপনি কত বড় নেতা, সেই পরিচয় প্রকাশ পাবে প্রতি রাস্তায় রাস্তায় ঢেকে থাকা অসংখ্য ব্যানার, ফেস্টুন আর পোস্টারের মাধ্যমে। 

 

তাই বলে, প্রচারণার মাধ্যম এই ব্যানার, পোস্টার মানেই খারাপ তা বলছি না। তবে, সেটা দৃষ্টিকটু লাগে তখন, যখন আপনার বাড়ি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে আপনার দূর দূর সম্পর্কেও কেউ নয়, এমন একজনের বড় বড় মাথাওয়ালা ছবি আর গুণকীর্তন দিয়ে ঢেকে রাখতে দেখবেন। শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত হতে নয়, বরং বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মূল ফটককেও ব্যক্তিগত প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে ঢেকে থাকতে দেখবেন। 

 

তবে, হয়তো আপনারা সেই কথাখানি শুনেন নাই, "নিজে যাকে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যাকে বড় বলে বড় সেই হয়"। এই কথার সত্যতার বহিঃপ্রকাশ করতেই হয়তো নেতার সাগরেদরা আমাকে, আপনাকে ইদের শুভেচ্ছা কিংবা রাষ্ট্রীয় শুভেচ্ছা, শোকবার্তা জানাতে নেতার পোস্টারখানা রীতিমতো আমাদের মুখের উপর ঝুলিয়ে রাখে। তবুও বলবেন, সেই নেতার সততা, একনিষ্ঠতা যোগ্য নেতামি আপনাকে মুগ্ধ করে না! এ বড় হঠকারিতা লাগে আমার কাছে।

 

এর দায়ভার আমাদের সাধারণ জনগণ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। কথায় বলে, 'শিকারী বিড়াল গোঁফ দেখে চেনা যায়'। কিন্তু এখনকার মতো আমরা এই প্রবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গোঁফ না দেখে বিড়াল চিনতে ব্যানার, পোস্টার খুঁজে বেড়াই।  তাহলে, আর নেতার কিংবা তার অনুসারী ডান হাত, বাম হাতদের দোষ কোথায়? আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছাতে কিংবা আপনার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সিল খানা পাওয়ার আশায়, যদি পুরো ঢাকা শহরকে পোস্টার, ব্যানারে ঢেকে দিতে হয়, তাহলে এমন নেতা আমাদের জন্য তো অন্ধের যষ্টি। এই নিয়ে আর মনে ক্ষোভ রাখবেন না ভুলেও, তার ক্ষোভ বোঝার মানুষ নয় মোটেও।

 

বেশ কয়েকবছর আগে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের বেশ কিছু আচরণ বিধি মেনে চলার ব্যাপারে হুশিয়ারি দেয়া হয়। এই লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক বেশ কিছু আচরণ বিধি তুলে দিচ্ছি,
*প্রার্থীর নির্বাচনী পোস্টার ঝুলিয়ে রাখতে হবে দড়িতে। পোস্টারে কেবল নির্বাচনী প্রতীক, প্রার্থীর ছবি এবং দলীয় প্রধানের ছবি ছাপানো যাবে। পোস্টার হবে নির্দিষ্ট মাপের এবং সাদা কালো, রঙিন পোস্টার নিষিদ্ধ।
* দেয়ালে লিখে কোন ধরনের প্রচার চালানো যাবে না। কোন যানবাহন, দালান, সেতু, সড়ক দ্বীপ ও ডিভাইডারেও ভোটের প্রচার নিষিদ্ধ।
*নির্বাচনী প্রচারে কোন গেইট বা তোরণ নির্মাণ করা যাবে না। চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে না কোনোভাবেই।
*প্রার্থী কিংবা সমর্থকরা ভোটের সমাবেশের জন্য ৪০০ বর্গফুটের বেশি আয়তনের প্যান্ডেল তৈরি করতে পারবেন না।
*মাইকে ভোটের প্রচার চালানো যাবে কেবল দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

 

আদতে এই সকল নিয়ম বা আচরণবিধির কোন বালাই নেই, কিংবা এখনো এই আচরণবিধি কার্যকর আছে নাকি নির্বাচন কমিশন 'বিড়ালের গোঁফ চেনা' নীতিতে কিছুটা শিথিল হয়েছে, তা জানার আগ্রহও হারিয়েছে সাধারণ জনগণ।নির্বাচন বাদেও সারাবছর ব্যাপি নেতাদের ওই স্মিত হাসির পোস্টারের জন্য আপনি শহরব্যাপি ফুটওভার ব্রিজ হয়তো দেখতে পাবেন, কিন্তু এর ভেতরের সৌন্দর্য দেখতে না পেলে মনক্ষুন্ন হবেন না, কারণ আগেই বলেছি, তার আপনার ক্ষোভ বুঝবে না।

 

বেশ কয়েকবছর আগে একটা দৃশ্য আমাকে ফুট-ওভার ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অগণিত উৎসুক জনতার কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। 'জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস' উপলক্ষে সড়ক ও জনপথ(সওজ) মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে সড়ক সচেতনতা সৃষ্টির উপলক্ষে একটি বিশাল ব্যানার ফুট-ওভার ব্রিজে লাগানোর কাজকর্ম দেখে তো চোখ ছানাবড়া। পুরো ফুট-ওভার ব্রিজ শত শত রাজনৈতিক ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টারে ঢাকা, সেখানে সচেতনতার ব্যানারের জায়গা কোথায়! সওজ কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক কর্মতৎপরতায় ফুট-ওভার ব্রিজকে পোস্টারমুক্ত করা গেলেও, সেই সচেতনতার ব্যানার কিন্তু বেশিদিন উঁকি মারতে পারে নি সেখানে। অর্থাৎ, তাদের সকল কর্মপ্রচেষ্টা জলেই গেল বলা যায়।

 

সারকথায় ফেরা যাক, আমাদের শহরকে আধুনিকায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনে সিটি কর্পোরেশন ও সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয় কর্তৃক শহরকে ব্যানার, পোস্টারমুক্ত করার প্রয়াস থাকলেও, তা বিফলে যায়। অর্থাৎ, ব্যানার-পোস্টারের রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব আমাদের দেশে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সেই দায়ভার জনগণকেও নিতে হবে। আমাদের সুস্থধারার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে জনগণের অংশগ্রহণ যতটা সীমিত, ততটাই উদাসীনতা দেখা যায় নেতার নাগরিক জীবনকে রুচিসম্মত ও সুন্দর করার ক্ষেত্রে। আর তাই ব্যানার-পোস্টারের রাজনীতিই হয়ে উঠেছে বিড়ালের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ