যে এলাকায় মুক্তিযুদ্ধটা ছিলো একদম ভিন্ন
৫০ বছরে পা দিলো বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব ও রক্তমাখা ইতিহাস কমবেশি সকলের জানা। কিন্তু এই এই রক্তমাখা যুদ্ধের ঘটনা অন্যান্য এলাকার থেকে ভীষণ আলাদা ছিলো সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য। রীতিমতো তারা ৯ মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা নীলফামারী। এই জেলার ডোমার উপজেলার চিলাহাটীর, নামাজীপাড়ায় বাড়ি মো. জসিয়ার রহমানের। চাকরি থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যক্তি ছিলেন ১৯৭১ সালে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বাড়ি থেকে ভারতের সীমান্ত দেখা যায়। দুরুত্ব প্রায় ৩শ’ গজ।
তার বাড়ি থেকে চিলাহাটী বাজার ৫ কিলোমিটার দুরত্বে। পাকিস্তানি সেনারা তার স্কুল চিলাহাটি মার্চেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘাটি গাড়ে। তারা এর বিভিন্ন কাজের জন্য বাজারের যাকে পেতো তাকেই নিয়ে যেতো। করিয়ে নিতো নানা কাজ। এই সুযোগটা নিয়েছিলেন যুক্তিযোদ্ধারা। তারা কিশোর জসিয়ারসহ বেশ কজনকে পরামর্শ দিলেন সেই কাজে যাবার জন্য। আর দায়িত্ব দিলেন স্টেশন থেকে কতো স্লিপার দুরে তাদের ঘাটি গণনা করবার জন্য।
জসিয়ার রহমান বলেন, প্রথমে এতটোই ভীত ছিলাম যাবার সময় গণনাই করতে পারিনি। এরপর কাজ শেষে ফেরার সময় গুণে গুণে এসেছিলেন তিনি। এরপর সেই দুরুত্ব জানান মুক্তিযোদ্ধাদের। এই তথ্যের ভিত্তিতে পাক সেনাদের ঘাটিতে আঘাত করা হয়। পরে জানতে পারি সেই আক্রমণে ২৮ জন পাক সেনা মারা গিয়েছিলো।
জসিয়ার রহমান বলেন, সীমান্ত এলাকা হওয়ায় ৯ মাসই সেখানে যুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বর্ডারের কাছে ভারতে আশ্রয় নিতেন। আর রাত হলে সীমন্ত পাড়ি দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতেন। নিয়মিত গোলাগুলি হতো। তাই প্রত্যেক বাড়িতেই খোঁড়া হয়েছিলো বাংকার। গোলাগুলির শব্দ শুনলেই আশ্রয় নিতাম বাংকারে। প্রায়শই ভয়ের মধ্যে নির্ঘুম রাত কাটতো।
সেসময়ের দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, খাবার কষ্ট খুব একটা সম্মুখীন হইনি। কারণ আমাদের জমিতেই সব কিছুর চাষ হতো। খুব জরুরি প্রয়োজনে বাজারে যেতো কিশোর বা বাচ্চা ছেলেরা। এমনভাবে বাজার করতাম যাতে ১০ থেকে ১৫ দিন আর বাজারে যেতে না হয়।
যুদ্ধের সময়ের স্মরণীয় ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের বাড়ি যেহেতু একদম বর্ডারে তাই পাক সেনারা বাড়িতে আসতো না। একবার বাড়িতে চলে এলো পাক সেনারা। তাদের মনেও ভয় ছিলো ভারতে ঢুকে পড়েছে কীনা এমন। তারা বড় ভাইসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে ফেলে। এরপর আমার বড় ভাইকে প্রশ্ন করে, ইন্ডিয়া কিদার হ্যায়?
বড় ভাই ভারতের সীমান্ত প্রায় ৩শ’ গজ দূরে হলেও বলেন, পাশেই। ৩০ গজ দুরে। একথা শুনে তারা হুইসেল বাজিয়ে পালিয়ে যায়। ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে পালানোর সময় সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা চলে আসে। জমির আইল দিয়ে লম্বা লাইনে যাচ্ছিল তারা। এমন সময় পাকসেনাদের ব্রাশফায়ার করে মুক্তিযোদ্ধারা। এতে ১২ জন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়।
তিনি আরো বলেন, যুদ্ধের সময় তার ভাবির কোলে সদ্য ভুমিষ্ট বাচ্চা। আমাদের বাড়িতে যেহেতু প্রায়শই যুদ্ধ হতো। তাই ভাবি বাবার বাড়িতেই অধিকাংশ সময় থাকতো। একবার ভাবিকে বাড়িতে নিয়ে আসছিলাম। রাস্তায় দেখি পাকিস্তানি সেনা ও কিছু রাজাকার আসছিলো। এই দেখে ভাবিকে পাশে একটি বাড়িতে ঢুকিয়ে দেই। এরপর নানা প্রশ্নের মুখে পড়ি কই যাচ্ছিলাম? কেন যাচ্ছিলাম? তিনি বলেন, আমি ভেবেছিলাম এটাই বোধহয় আমার জীবনের শেষ দিন। হয় আমাকে ধরে নিয়ে যাবে বা গুলি করে মারবে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেদিন আমাকে কোন শারীরিক আঘাতেরও সম্মুখীন হতে হয়নি। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে ছেড়ে দেয় আমাকে।
ভারতীয় সীমান্ত পাশে হওয়ায় যুদ্ধ করে নিরাপদে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে অবস্থান নিতে পারতো এই কারণে এই এলাকায় যুদ্ধটাও হতো বেশি। হুটহাট করে বেধে শুনতে পারতাম গেলাগুলি। অনেক সময় পালানোর সুযোগ মিলতো না। রাতের পরিবেশ এমন ছিল মনে হতো জংগলে বসবাস করছি। পাশের বাসায় কি হচ্ছে সেটা জানারও সুযোগ সাহস কোনোটাই ছিল না।
৫০বছরে বাংলাদেশ। যুদ্ধের ভয়াল স্মৃতিতে বিজয়ের আনন্দ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, একটাই কথা বলব। আমরা পাহাড়সম শত্রু শক্তিকে পরাজিত করে জয় ছিনিয়ে এনেছি। আমরা ত্যাগ করেছি সোনার বাংলাদেশ গড়তে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিচার না করে চাই বাংলাদেশ হয়ে উঠুক স্বপ্নের মতো। ঘুম থেকে উঠবার পরও যে স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে।