আফরোজা ইকরামের কাব্যগুচ্ছ
১.
আসা, যাওয়ায় সবাই
একা খেয়ার মাঝি
তবুও কত মায়ার ঘর বাধি?
এপারেও খালি হাত
ওপারেও তাই
তবুও কেঁদে বুক ভাসাই
আজন্ম আক্ষেপে
নিরন্তর নক্ষত্রপথে হাঁটা
যদি ছুঁয়ে দেই গোটা আকাশটা, তবুও
বেলকনিতে ফেরার ব্যাকুলা মন
কি খুঁত খুঁজের লড়াই
সাতসকাল আর ভর দুপুরবেলা
পালঙ বানাই ভাবনার নকশায়
শামুকভাঙা বিকেল বেলা
আনত মুখে
আখের ছড়ি হাতে
বড্ড উদাস
লালন বসত করে মনে
মাথার জটাজাল সাদা হলে
বৈশাখী বৈরাগী
অগ্রহায়ণে গেরুয়ায় রাঙি
মেঠো মাটির গন্ধ মেখে!
২.
মৃত্যুর ছায়া ঘনায়
ঘুমের দেশে যেতে
কখন ফানুস হয় হাওয়াই মিঠাই?
সব মিথ্যে, স্তিমিত আলোকে ঘোরতর কোন্দল
পায়ে পায়ে
শূন্যে ফিরে এসে শূন্যে মিলায় নৌকোর খোলে।
হবে হয়তো কাটা গলায়
দশমিক শতাংশ
হট্টগোলে
আদতে দরজাই থাকে
লুকিয়ে।
কে কবে গহ্বরে
কে কবে চিতানো বুকে
আঙিনায় দাঁড়িয়ে!
তবে…?
৩.
কুয়াশার ভোরে পৃথিবীর অবাক মোহময় গল্পের শুরু। ভালোবাসার আর ঘৃণার যুগল পথচলা। দ্বন্দ্ব তো সবসময়ে একরকম রঙের সুতোয় বোনা নয়। কিছু অস্বস্তিকর নীরবতার পর ভালোবাসার চাদরে যদি গোটা জীবন মুড়িয়ে দেয়া যেত তো বেশ হতো।
মনিপুরী সস্তার চাদরে নীরা মুড়ে নেয় নিজেকে। সুতোয় ভালোবাসার ওম না থাক এই কনকনে শীতে অদ্ভুত আরাম পায় ও। নিজের ভেতরের কেউ একজন কত কথা কয়ে যায় শোনার ইচ্ছে থাকলেও সময় নেই হাতে। একটানে ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে রাস্তায় নামে সে। ঘড়ি দেখে এক ঝলক। না, দেরি হয়নি আজ। অফিস গাড়ি আসার তিন মিনিট আগেই আসতে পেরেছে। হাসপাতালের চাকরি করতে বড্ড ভাল লাগে। প্রতিটি মুহূর্তই উত্তেজনা, উৎকণ্ঠায় ঠাসা। আর যাই হোক, একঘেয়ে লাগে না কখনোই। শুধু গন্ধগুলো কেমন বদলে বদলে যায়। জীবন আর মৃতের এক এক রকম রঙ আর গন্ধ। কেমন গুমোট, গুমরানো আর উদাস, উদাস।
আঠারো বছরেও নীরার অনুভূতিগুলো একইধরনে কাজ করে যায়। একই ছন্দে। জীবনের উচ্ছ্বাস আর মৃতের শূন্যতা সব হৃদপিণ্ডটা জুড়ে কোলাহলময়।
৪.
কথার খেলায় রোদ্দুর হাসে। ফাল্গুন কড়া নাড়ে। দেখা হয় বনের মাথায় পাখির সাথে। একা চুলার জ্বালে নতুন গুড়। কড়াইয়ে ফুটছে। তামুক গন্ধ ছড়ায় ভালোবাসার ঠোঁটে। পেঁচার অপেক্ষা শিকার সন্ধানে। জারুলের ফুল দোলে। উতাল মন উড়ে। জঙধরা দায়ে কাটা মাছের ঝাল আর ফেনা তোলা ভাত অমৃত। একটু কচকচ। তারপর সুরুত করে তৃপ্তির ঢেকুর। কবিতার প্রকৃত উৎসব ভাতের এক এক গ্রাসে।
৫.
কোনো একদিন…ব্যক্তি মানুষ যে বড্ড ঘরকুনো। কুয়োর ব্যাঙ। যেদিন চলতে শিখে যাব, মেঘরঙা ক্যানভাসে রোদ আর রঙধনু আঁকা হয়ে, শরতের কাশবনে উদাস হয়ে পৃথিবী দেখে, পায়েচলা পথেঘাটে ছাপ রেখে….অনন্ত অভিযাত্রায় ঠিক মানুষ হয়ে উঠবো। এখন থাকুক কুয়াশার ধূম্রজালে ঢাকা আমার মনুষ্যরূপ!
৬.
আজ নয় কোন কান্না
সব দুঃখ, বঞ্চনা দিলেম উড়িয়ে
নীল, নীল আকাশের ঐ সুনীলে।
যন্ত্রণার সুর করুণ রাগে
আজ যেন না বাজে,
শান্তি আসুক ধরার বুকে।
বাঁধনহারা পায়রার পাখায়
মেলে স্বপ্নডানায়,
ইচ্ছেঘুড়ি রঙিন সুতোয় বেধে
হারাবো আজ অচিন দ্বীপে।
আজ নয় কোন কান্না
সব দুঃখ, বঞ্চনা দিলেম উড়িয়ে
নীল, নীল আকাশের ঐ সুনীলে।
গল্পের পরে রূপকথা হয়ে
নদীর দুকূলে ভেসে ভেসে
মাটির কাছে, সবুজে,
শিশিরজলে যাবো মিশে।
আজ নয় কোন কান্না
সব দুঃখ, বঞ্চনা দিলেম উড়িয়ে
নীল, নীল সাগরের ঐ সুনীলে।
৭.
উত্তরে, আমার ভালোবাসায় ছোট্ট টবে চাষ করি আমাকে। আমার শরীর বেড়ে উঠছে ঠিকঠাক। রোদ্দুরে গাল ফুলিয়ে হাসি। যদিও তোমরা বোঝো না সেটা। চোখ মুখ নেই এখনো। তাই আমাকে দেখতে কেমন লাগে তোমাদের? এক গ্লাস পানি দরকার আমার। মনুষ্যত্ব মিশিয়ে দিও তাতে। আর দিও স্বপ্নিল রংধনু। গল্প বলবে সবুজ মাঠের? জানো, কাল আমি বৃষ্টির সাথে কথা বলেছি। ওদের বাড়ি একদিন বেড়াতে যাব। মেঘবুড়ি আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আলমারি ভর্তি করে বই দিও আমায়, অবসরে পড়ে দেখবো। একচিলতে আকাশ দিওতো আমায়, নীলে রাঙা হবো। আর দিও কেয়াফুলের সুবাস।
৮.
জীবনের বাকে বাকে শুধুই কি উষ্ণতা? কালো চিতার ক্ষিপ্ততা? কোলাহল? ছন্দ? কতখানি সত্যি বেঁচে থাকার স্বপ্নগুলো? একমাথা কাশফুল নিয়ে ক'টা মুখ গ্লানিহীন হাসিতে উদ্ভাসিত?
অনেকটা বেলা, দীর্ঘ সময় স্রোত কেটে কেটে অপার অসীমে পৌঁছানো যায়। ক'জনে পারে?
আমি পারতে চাই, আমার আমি'র নিঃশেষে, নিঃশব্দে শব্দময় হয়ে।
৯.
যদি দেখা হয় শেষ-বিকেলের আলোয়?
সব পুরনো কথা নতুন খামে, সব মাধবীলতা ফুলে গন্ধ বাহারে? যদি আবেগহীন সময়ে থোকা থোকা জোনাক জ্বলে? মাকড়শারজালে হয় বন্দি সবে? ধোয়া ওঠা ভাপা পিঠা আর কুয়াশা হাসে ছন্দে?
যদি বেলি আর খোঁপা জড়ায় ভালোবাসায়? উঠোন, পায়ে চলা পথে যদি দেখা হয়?
১০.
আমি একা একা হাটতে হাটতে হেটে যাই এক পৃথিবীর পথ। বৃষ্টিতে ভিজে যাই, ধানের ক্ষেত পার হয়ে যাই। সবুজ কার্পেটের স্পর্শে বিবশ হয়ে যাই। মাথার উপরের আকাশের দিকে বলি চল বেরিয়ে আসি।
হাঁটতে হাঁটতে হেঁটে যাই নগর সভ্যতার অলিগলি। আমার সাথে কথা হয় তাদের। অনেক কথা। গোপন ও প্রকাশ্য কথা। মাথার উপরের আকাশ সাক্ষী থাকে বাকহীন হয়ে। আমি কিশোরের বিকেলকে দেখেছি স্বতঃস্ফূর্ত, সন্ধ্যায় তরুণের হতাশা, রাতে মায়ের আর্তনাদের প্রতিচ্ছবি, বাবার শোকার্ত মুখ। আমি শুনেছি নিত্য বাসর ভাঙা রাতের নারীর হাহাকার। জঠরের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা মানুষের আকুতি। মেকআপ তোলা অভিনেতা আর বাস্তব মানুষের দ্বন্দ্ব। স্বপ্নচারীর স্বপ্ন ভাঙার আর্তনাদ। বাতাসে উড়ছে বিষাক্ত জিঘাংসা। বিবর্ণ প্রজাপতি উড়ে সবখানে। ঘুমপাড়ানির গানে বিভোর বিবেক। লাশের পাহাড়ের উপর সভ্যতার অগ্রযাত্রা। অগ্রসর হতে হতে রঙ বেরঙের মুখোশ উন্মোচিত হয়। আমি এগুতে থাকি আর পা পিছলে পড়ে যাই রক্তের স্রোতে। ভাষার রক্তের স্রোত, একাত্তরের মার্চের হামলার রক্তের স্রোত, একাত্তরের নয় মাসের রক্তের স্রোতে ভেসে যাই। সামনে এগিয়ে আবার রক্তের মাঝে হাবুডুবু খাই। জীবনের বাঁকে বাঁকে শুধুই রক্তের নদীর স্রোত। হঠাৎ ধাক্কা লাগে অশরীরী কারো সাথে। যারা আমার পথরোধ করে ন্যায় বিচারের দাবিতে। আশ্বাস চায়। আমি আশ্চর্যরকমে বোবা বনে যাই। পাশ কাটিয়ে দেই ওদের। হেঁটে যাই মানব পৃথিবীর সময়ের সব আবর্তনে।