বাবার জন্য
সারা দিন কত মটিভেশনাল স্পিচ, ভিডিও ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য করতে অস্থির থাকি আমরা। রাতে ডিনারের সময় যখন কাজ নিয়ে গল্প করা হয় তখন বেষ্ট মটিভেশন যেন বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। বাবা খুব সাধারণ বিনয়ী একজন মানুষ। নিজের মধ্যে কোন অহংকার তো নেইই কোন কিছু অর্জনের অস্থিরতাও নেই। সবে ক্যারিয়ার শুরু করেছি। নিজেকে সিইও হিসেবে দেখতে চাই, তাই লিডারশীপ নিয়েও প্রচুর মনোযোগী হতে হচ্ছে। আমার অফিসে যাওয়া ব্যস্ততা সব দেখে বাবা বললেন, খোকা একবার নিজের দিকে মন দে।
আমি খুব দুর্ব্যবহার করতাম বাবার সাথে। এত বছর সরকারী চাকরি করে কি করেছো তুমি? বাবা উত্তর দিতেন না। এক বছর আগে বাবাকে হারিয়েছি। বাবা ছাড়া এটাই প্রথম বাবা দিবস। তবে এ বছরটাতে আমিও বাবা হয়েছি হঠাৎ করে মনে পড়লো আমার ছেলেও কি আমার সাথে এমন আচরণ করবে?
এই গল্পটা যেন বর্তমান তরুণ প্রজন্মের প্রায় সব ছেলে মেয়েরই গল্প। নতুন চাকরিতে জয়েন করে বাবার চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করে আমরা কি এক অদ্ভুত অহংকারের সাগরে ভাসি। 'দেখো তোমার চেয়ে আমার মানিব্যাগ ভারী', এ প্রতিযোগিতা কার সাথে করি আমরা? সেই মানুষটার সাথেই তো যিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, কষ্টে উপার্জন করে আমাদেরই মানুষ করেছেন? কার মানিব্যাগের প্রতিযোগিতা বাবার মানিব্যাগ তো সেই মানিব্যাগ ছিল, যেখান থেকে আমাদের খুশি আসতো। ছোট ছোট কোন বায়না বাদ যায়নি কখনো। খেয়াল করেছেন কি বাবা কত মিথ্যে বলেছেন? অভিনয় করেছেন, ভাল থাকার অভিনয়। কখনো নিজে না খেয়ে থেকে খেয়েছে বলার অভিনয়।
প্রথম স্যালারি পেয়ে বন্ধুদের ট্রিট দিচ্ছেন, চিকেন খাচ্ছেন, কিন্তু যিনি বাবা তিনি তার অনেক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানেও যেতে পারেননি প্রত্যেক মাসে আপনার জন্য এ কৌটো নিডো নিশ্চিত করতে। মেয়েদের অনেক ফ্রক, সাজগোজের বায়না, ছেলেদেরও খেলনা গাড়ি, কেডসের বায়না। কিন্তু বাবাদের এক জুড়া জুতো, সেটা সেলাই করেই চলে বছরের পর বছর। কখনো এমন হয়েছে কি টিউশনির টাকা দিয়ে বাবাকে এক জুড়া জুতো কিংবা একটা সাধারণ স্যান্ডো গেন্জি কিনে দিতে পেরেছেন? বিয়ের পর বৌ সহ্য করতে পারলো না আপনার বাবা-মাকে। আলাদা হলেন ভালো কথা, কিন্তু খেয়াল রাখতে পেরেছেন কি জন্মদাতার যে লালন-পালন করলো এতটা বছর? গোপনেও কিন্তু খেয়াল রাখা যায় কেবল সদিচ্ছার ব্যাপার।
বাবা দিবস এলে বাবার সাথে ছবি দিয়ে আমরা হইচই শুরু করে দেই। 'ভালবাসি বাবা' বলে কিন্তু মুখে বলা হয় না কোনদিন। ১৯১০ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটনে সনোরা স্মার্ট ডড বাবা দিবসের প্রবর্তন করেন। শৈশবে মাতৃহারা সোনারার পরিবারের জন্য বাবাই ছিলেন, সব তাদেও মানুষ করতে বাবার ত্যাগ তাকে অনুপ্রাণিত করে, তাই কন্যা চেয়েছিলেন বাবাকে ধন্যবাদ জানাতে। তার আহ্বানে সারা দিয়েই পালন করা হয় বাবা দিবস। অনেকে প্রশ্ন করতেই পারেন বাবাকে কেন ধন্যবাদ জানাতে হবে? এগুলো গিফটের দোকানের বাণিজ্য। সত্যি বলতে, বাবা মায়ের জন্য গিফট কোন দোকানে পাওয়া যায় না। সন্তান ই বাবা মায়ের বড় গিফট। সন্তানের পয়সা নয়, সাফল্যই থাকে বাবা মায়ের কাম্য। যে সাফল্য ও সুখকে নিশ্চিত করতে তারা তাদের নিজেদের চাওয়া পাওয়াকে বিসর্জন দেন ।
বিশেষ দিনে গিফট নয় প্রতিদিন বাবা-মায়ের সাথে হাসি মুখে আচরণ তাদের সাথে আনন্দ শেয়ার করা নিজেকে উন্নত করতে বাবার পরামর্শ আপনাকে আরো অনুপ্রেরণা যোগাবে। মনে হতেই পারে গোগল সব সমস্যার সমাধান করে দিবে, একবার বাবার শরণাপন্ন হয়ে দেখুন কত নিখুঁত ও সহজভাবে আপনি ব্যবহারিক জ্ঞান পাচ্ছেন। ভালো বই পড়ে শেয়ার করুন বাবার সাথে, মনে পড়ে শিশুকালে বাবার অংক করানোর কথা পড়ানোর কথা। যতটা সময় বাবারা আমাদের দেন তার এক ভাগও দেবার চেষ্টা করলে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়।
বাবা একজন সন্তানের সবচে বড় বন্ধু, বিপদে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও অনেক সময় বাবাই সন্তানকে মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে আনেন। জানতে চেষ্টা করুন, বাবার অতীত জীবন যা আপনাকে জীবন নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শেখাবে, সামনে এগিয়ে চলার পথ দেখাবে। বাবা হয়তো গান কবিতা ভালবাসেন, বাবাকে তার প্রিয় লেখকের একটা বই দিয়ে চমকে দিতেই পারেন। বাবা যদি রিটায়ার্ড করে থাকেন তো তার সময় কাটানোর ব্যবস্থা আপনিই কওে দিতে পারেন , ইন্টারেস্টিং কোন কাজের মাধ্যমে যাতে তার মন ভালো থাকে। পুত্র কন্যা উভয়ের জীবনাদর্শ বাবা । বিয়ের পর একটা কন্যা বুঝতে পাওে তার বাবার বাড়ি ও স্নেহের মর্ম।
একজন সন্তান বাবা থাকা অবস্থায় কিছুতেই পুরোপুরি ম্যাচিউরিটি পায় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত বাস্তবতা সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবা এমন সুপারম্যান, আলাদীনের চেরাগের দৈত্য যে সন্তানের সব সমস্যার সমাধান তিনি একাই করতে চান। যে বাবার কোলে চড়ে শহর ঘুরেছেন,কাঁধে চেপে মেলা দেখেছেন কিংবা ঘোড়া বানিয়ে রাজপুত্র সেজেছেন সেই বাবাটিকে রেখেন না ওল্ড হোম কিংবা অবহেলায়। বাবা সে আপনার বাবা হোক আর জীবন সঙ্গীর বাবা দুজনকে দেখুন সমান চোখে।
বাবাদের হৃদয় অনেক বড় হয় সেখান থেকে কিছুটা শিখুন। সহজ করুন জীবনকে যেন বাবা না থাকলে আফসোস না করতে হয়। আপনি আপনার বৃদ্ধ-জীবন যেমন দেখতে চান যেমন প্রত্যাশা করেন নিজ সন্তানের কাছে ঠিক তেমন আচরণ করুন বাবার সাথে। বাবার দেখানো সততা, প্রতিযোগিতাহীন সাধারণ পথে হাঁটুন, শান্ত থেকেই কাজে শানিত করুন নিজেকে। বাবার মতো হাসুন সব কষ্ট চেপে, দেখবেন পুরো পৃথিবী হাসছে আপনারই সাথে। জেনেটিকের কারণে উপলব্ধি করবেন বাবা সে তো সবসময়ই থাকে আপনারই মাঝে।