বিপন্ন সময়
জালালুদ্দিন সামান্য হাঁউমাঁউ করতেই সাকেন দারোগা চিৎকার করে উঠল। তার সেই চিৎকারে আনন্দবাস গ্রামের সীমান্ত ফাঁড়ির চারপাশে অন্ধকারে চাপাপড়া নৈঃশব্দ্য থরথর করে কেঁপে উঠল। পাশের শিমূল গাছ থেকে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল একনিশাচর পাখি। তবু মিনমিন করে জালালুদ্দিন মাঝি বলে, ‘চ্ছার আমি কিছু জানিনে গো…’। দারোগা সাহেব চেয়ারে একটা লাথি মেরে আবার চিৎকার দিয়ে ওঠে সাথে অশ্রাব্য কথার খই ফুটতে থাকে-‘ওরে আমাগের সুমুন্দী রে; খানকির ছাওয়াল তোর মাখকে আমি…শুয়ারের বাচ্চা তুমার ঘরের টিন উড়ছে, মাতা ফাটছে অন্য লোহের, আর শালা তুমি জানবানা, দুডো সিলাই পড়েছে! অ্যাটেম্প টু মার্ডার’ বলেই হাতের পাশে রাখা মোটা বেতের লাঠি দিয়ে জালালুদ্দিনকে পেটাতে শুরু করল। জালালুদ্দিন প্রথম দুটোতে চিৎকার করে ওঠে; তারপর যেন সব অবশ হয়ে যায়। সে একটা ঘোরের মধ্যে লাঠির বাড়িগুলো শরীরে নিতে থাকে।
সেই ঘোরের মাঝে সে দেখতে থাকে দেড় কেজি ওজনের জ্যান্ত শোল মাছ নিকানো উঠানে মেলে বেড়ায়…না খাওয়া শরীর নিয়ে বৃদ্ধ মা অন্য বাড়িতে যায় উনুনের ছাই ধার করতে…একটা ধরন্ত লাউয়ের মাচার নিচে বিড়ালটা তার বাচ্চা নিয়ে খেলতে থাকে। ভৈরব নদীতে কলকলিয়ে বান ডাকে… জালালুদ্দিন মাঝি বৈঠা হাতে বুক উঁচিয়ে দাঁড়ায়। তবে জালালুদ্দিন এমন মাঝি নয়, শুধু মাঝি তকমাটি রয়ে গেছে নামের শেষে। মাঝি ছিল তার দাদা; পরান মাঝি। বড়ো নৌকা ছিল তার। ভৈরব নদও ছিল বিশাল! কূলকিনারাহীন। আষাঢ়ের শুরুতেই কলকল করে বান ডাকত। কালো পানি সারাটা বর্ষা শাসন করত দশগ্রাম। গ্রীষ্মকালে সেই নৌকায় পরান দাদা ছই জুড়ত। ভিন্ন গ্রাম থেকে যাত্রী আনতেন তিনি। কখনোবা উড়াতেন পাল। দীর্ঘদিন বৈঠা বয়ে শরীরে জলশ্যাওলার গন্ধ নিয়ে গ্রীষ্মের এককাঁঠফাটা দুপুরে কাশতে কাশতে ঘরের পিছনের বাঁশঝাড়ে শুয়ে পরান মাঝি আর ওঠেনি। ঘরের কোণে দীর্ঘদিন তার বৈঠাটা পড়েছিল।
আনন্দবাস পুলিশ ফাঁড়ির ছোট্টঘরে সাকেন দারোগার পায়ের ফাঁকে পিছমোড়া অবস্থায় অর্ধচেতনের মাঝে জালালুদ্দিনের কানে সেই কাশির দমকের শব্দ ভেসে আসতে থাকে। কেউ যেন কাশির দমকের মাঝে একটু দম নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রাণপণে…।
সাকেন দারোগা হাঁপিয়ে ওঠে; লাঠিটা ছুড়ে ফেলে চেয়ারে বসে হাঁপাতে থাকে। একটু বাতাসের জন্য ওর ফুসফুসটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে এই মুহূর্তে। হাঁপের ফাঁকে বলতে থাকে, ‘হালার পো, তোর ঘরে টিন আলগা, হেইডা কি আমি আটকাবো, চুদির বাই…’ জালালুদ্দিনের অন্যায়টা সাংঘাতিক! সাকেন দারোগার ধারণা এই সাংঘাতিক ঘটনার জন্য সেই-ই দায়ী। জালালুদ্দিনের তিন কাঠার উপর ছোট্ট কুঁড়েঘর। উঠানের কোণে একটা সজনে গাছ তার নিচে লাউয়ের মাচা। যে টিনগুলো এতদিন সূর্যের তেজ ও বর্ষার দাপট ঠেকিয়ে এসেছে- সেগুলো এখন বেশ জীর্ণ হয়েছে। এ বছর গ্রীষ্মের তেজ প্রথম থেকেই। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে এল বৈশাখের প্রথম দমকা। দুপুর থেকেই গুমোট থাকা আকাশ বিকেল হতে না হতেই কালো মেঘের চাঁদর গায়ে জড়িয়ে হলো অচেনা। শোঁ শোঁ শব্দ করে কোত্থেকে উড়ে আসল ঝড়। মরা ভৈরবের বুকের মরা সাঁকোকে উল্টে নিরীহ আনন্দবাস গ্রামের উপর আছড়ে পড়ল ঝড় বর্গী দস্যুর মতো।
ওলটপালট হলো সারাগ্রাম। কড়াৎ কড়াৎ করে নীল আলো ছড়িয়ে বাজ পড়ল নদের বিরান পাড়ে। মড়মড় করে ভাঙল পাঁকুড় গাছের ডাল। ছিটকে পড়ল পাখির বাসা আর চোখ না ফোটা পাখির ছানা। জালালুদ্দিনের উঠানে সজনে গাছের ডাল ভেঙে ধরন্ত লাউয়ের মাচানের খুঁটি ভেঙে দিল। আর টিনগুলো জীর্ণ ঘরের মায়া ছেড়ে টিনের নিচের মানুষগুলোর কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো উড়ে গেল শূন্যে। ‘ওরে আল্লা রে’ বলে কলমী উড়ন্ত টিনের পিছু নিল। জালালুদ্দিন টিনহীন ঘরের খুঁটি ধরে বসে থাকল। কলমীর চিকন মেদহীন চিপছিপে শরীর বৃষ্টির জলে ভিজে লোহা কালো রঙে রঙিন হয়ে আরো চকচকে হয়ে উঠল। টিন তখন পাঁকুড়ের ডালে। দুচোখে ক্ষোভ-কষ্ট আর হতাশা নিয়ে সেই টিনের দিকে তাকিয়ে থাকে কলমী। পাঁকুড় গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায়। সেই আকাশের বুক চৌচির করে বিদ্যুৎ ঝলক খেলায়; ঝরে পড়ে বৃষ্টি। আর ঝরে দুঃখ-কষ্ট অভাব। এই দুঃসময়েও তার মনে প্রশ্ন জাগে এসব কোত্থেকে আসে? এই বিশাল আকাশের ওপাড়ে কি আছে? সবকিছু ছাপিয়ে কলমীর দীঘল কালো দুচোখে কষ্টের প¬াবন নেমে আসে। সেই লোনা মিশে যায় হিম শীতল সলীলধারার সাথে, বৃষ্টির জল চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় মুহূর্তেই।
ফালি পটলের মতো একচিলতে সংসারে উথাল-পাতালের অভাব। মাঝির নাও নেই, ভৈরবনদে জল নেই, গ্রামে কাজ নেইÑতাই জালালুদ্দিনের ঘরে খাবারও নেই। আছে কলমী। গ্রামের বিল-খাল যেমন আলো করে থাকে কলমীলতা ও তার বেগুনী-ফুল, ঠিক তেমনি মাঝির কুঁড়ে আলো করে আছে কলমী। আঁতিপাতি করে সে খুঁজে আনে কচুশাক, আলতা পেটি আলু, জলে ভাসা শাপলা- তারপর সন্ধ্যা নামলে উঠানের কোণে উনুন জ্বলে ওঠে। ঝরাপাতার আঁচে কালো কড়াই এ চুড়চুড় শব্দ তুলে সিদ্ধ হতে থাকে হলুদ মেশান শাকের পাতা। উনুনের আঁচে কলমীর মুখের পাশটা রাঙা হয়ে ওঠে, আর চারপাশে জমে থাকা নিরেট অন্ধকারকে আরো ভৌতিক করে তোলে। জালালুদ্দিন হাঁটুমুড়ে বিড়ি টানে আর পিটপিট করে দেখতে থাকে কলমীর কাপড় সরে যাওয়া বুকের সাদা অংশ। চোখাচোখি হলে লজ্জা পায় কলমী। জালালুদ্দিন একটা মুচকি হাসি বিড়ির ধোঁয়ার সাথে গিলে নেয়। সেই সাথে সে এ ক্ষুদ্র সংসারের আকাশছোঁয়া অভাবকেও মহাশূন্যে উড়িয়ে দেয় এক ফুৎকারে। তার কাজহীন জীবন, জীর্ণকুঁড়ে আরো হাজারো না পাওয়ার ক্ষোভ নিমেষেই উধাও হয় বিড়ি খাওয়ার তৃপ্তির সাথে। রাত গভীর হলে ওদের নিশ্বাসও ঘন হয়Ñঘর্মাক্ত হয়; তারপর একসময় নিদ্রাদেবী আঁচল ধরে অপেক্ষা করে আরো এক দুঃসহ দিন আর মধুময় রাতের জন্য।
সকালে যখন সাকেন দারোগা তার পেট মোটা মোটর সাইকেলটা ভটভটিয়ে গ্রামের ধুলো উড়িয়ে যাচ্ছিল জয়পুরে একটা চুরির তদন্তে, তখন কলমী তার বেড়াহীন বাড়ির উঠানে লাউয়ের মাচার তলে। দারোগার শকুন দৃষ্টি তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করছিল। সাকেন দারোগা না দাঁড়িয়ে পারে না। তারপর একসময় মোটা গলায় ডাক দেয়, ‘অই ছেড়ি, তোর লাউÑ অই জয়পুর যাওনের রাস্তা কি এইডা?’ মেয়েরা পুরুষের চোখের না-বলা ভাষা হয়ত পড়তে পারে। কলমীও সেদিন দারোগার সেই ভাষা পড়েছিল তার সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে। সে কোনো উত্তর না দিয়ে খাটো কাপড়ে যথাসাধ্য শরীর ঢেকে সজনে গাছটার আড়ালে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করেছিল। অবশ্য ঐদিন সাকেন দারোগা আর ওখানে দাঁড়ায়নি বেশি সময়। কিন্তু আবার এসেছিল : তারপর আবার। সেদিন তো কলমী খুব কাছে দাঁড়িয়ে ওর চোখের তীব্র লালসা দিয়ে কলমীর সারাশরীর চেটেপুটে তুলেছিল। একসময় বলে, ‘তুই আমার কুয়াটারে আসেবেনেÑকাজ দিবানে; আর ও মাঝি শালা কি তুমাক পালবির পারে? শাড়ি টাহা-পয়সা, গন্ধ সাবান দিবানে…এশার নামাজের পর আসপা।’- বলে কলমীর হাতটা ধরতেই সে চিৎকার দিয়ে ওঠে।…আসলে দোষ মূলত এখানেই। কলমীর রাজি না হওয়া। সাকেন দারোগার বুকের আগুন শ্মশানের চিতা হয়ে ওঠে। আসে ঝড়। আর সাথে সাথেই তৈরি হয় মামলা; তুলে আনা হয়েছে জালালুদ্দিন মাঝিকে। এবার কলমী আসতে কতক্ষণ…সিগারেট জ্বালিয়ে দুটো কড়া দম দিয়ে মিচকি একটু হাসি সাকেন দারোগার কালো মোটা তাগড়া ঠোঁটের দুপাশে খেলে যায়।
ইতিমধ্যে জালালুদ্দিনের ঠোঁট ফুলে গেছে; পায়ের গিঁটে ফুলে গেছে যন্ত্রণায় বেহুঁশ পড়ে আছে সে ফাঁড়ির প¬াস্টার চটা মেঝেতে। বাইরের অন্ধকারে তখন আনন্দযজ্ঞ মেলছে। নাম না জানা ফুলের সুগন্ধে বাতাস বইছে নির্মল। অন্ধকারে ভেসে বেড়াচ্ছে জোনাকির দল। অন্ধকার এত সুন্দর কই করে হয়? কেন আর কার জন্য হয়ে ওঠে- কে জানে।
এই জমাট ঘোরের মাঝে জালালুদ্দিন দেখে তার আধাবেলা খাওয়া বৃদ্ধ মা; সাদা কাপড়ে শরীর ঢাকা; সাদা কাপড়ে ধুলো কাদার ছোপসে বলে, ‘মা তুই কুত্থেকি আলি? এভাবে তো আসতি ন্যায়; এখানে আলি ক্যানে- ওমা?’ ‘মন মানে না বাপজি ! বড়ো মায়া লাগে! ও জ্বালাল তুই শোলমাছ খাসনি কেন বাপ?’…
জালালুদ্দিনের মনে পড়ে যায়, ভৈরবের পাঁক থেকে পাওয়া শোলমাছটার কথা। কালো, পেটের দিকে সাদা দুধÑ সাদা। চোখ দুটো কালচে নীল! ভয়াল ! মাছটা নিকানো উঠানে এঁকেবেঁকে খেলছিল, বাঁচার পথ খুঁজছিল। জালালুদ্দিনের মা, দেওমন বেওয়া অসুস্থ শরীরে অন্য বাড়ি যায়, ছাই ধার করতে, মাছ কাটবে। অনেকদিন পর একটা বড়ো মাছ কাটবে সে। আল্লায় দিছে এই অসময়েÑ‘মা তুই আবার আলি ক্যানে? প্যাটে ভাত নেই শরীরে বল পাইচু না’…ছেলের কথার আমল দেয় না দেওমন বেওয়া। কাঁপতে কাঁপতে শোলটার পাশে বসে সে। জালালের চোখে কৌতূহল। লাফিয়ে ওঠে নিরীহ শোল ; শুকনো উঠানে আপাল দিয়ে ওঠে জলের রাজ্যের মতো। সজোরে বাড়ি মারে দেওমন বেওয়ার কান ও চোয়ালের মাঝে। দেওমন কাত হয়ে পড়ে যায়। স্থির হয়ে যায়। ছেলের জন্যে বড়ো মাছ কাটা আর হয়ে ওঠে না, জালালুদ্দিন চিৎকার করে ওঠে, ‘মা, ও মা…তুমাকে খুব মেরিচে? খুব ব্যাতা করচি?’ জালালুদ্দিনের কানে ভেসে আসে ক্ষীণ মায়াময় এক কণ্ঠস্বর। মনে হয় বহু যুগের ওপার থেকে কেউ তাকে ডেকে চলেছে; তার শরীরে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পড়ে। সে জগতে ফিরে আসতে থাকে… কলমী বলে, চ্ছার তুমাকে ধরিচে ক্যানে? তুমি কি খুন করেচ?’ ‘কলমী! তুই আলি কখন? ক্যানে আলি?’
– ও আল্লা, তুমাকে নিতি আলাম; ছার খুব ভালো।
– হুম।
– তুমাকে মেরিচে?
– নাহ।
– গায়ে ব্যাতা?
– কি জানি- লাউয়ের মাচাটা ভেঙে গিয়েছে বোল? মানুষের মাতা ফেটিচে?
ঘড় ঘড় করে কথা বলতে বলতে জালালুদ্দিন চোখ মেলে চায়। সে দেখে কলমী তার দিকে ঝুঁকে আছে। তার শরীরে অভাবের গন্ধ। সে জালালুদ্দিনের শরীরে হাত বোলায়। ঠান্ডা হাত। কলমী বলে, ‘তুমি মাচার চিন্তা বাদ দ্যাও তো; ফার্সা হলি আমরা বাড়ি যাব।’ ‘এখন কি রাত? রাত কত?’ ফ্যাস ফ্যাস করে জালালুদ্দিন মাঝি জিজ্ঞেস করে। ‘তুমি এখানে থাকো- আমি ছারের সাথে কতা বুলি’, কলমী উঠে যায়। জালালুদ্দিন আবার ঘোরের মধ্যে ডুবে যায়। সে দেখতে থাকে শোলমাছ; স্থির হয়ে যাওয়া অসুস্থ মা; দাদাজানের নৌকা; কলমীর টইটুম্বুর শরীর। সে দেখে, শোল মাছের ভয়াল চোখের সাথে অদ্ভুত মিল সাকেন দারোগার কুতকুতে চোখ দুটোর।
ঘরের বদ্ধ অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে আনন্দবাস পুলিশ ফাঁড়ির সাকেন দারোগা। মিশকালো অন্ধকার সারাঘরজুড়ে শুধু তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা উঠছে আর নামছে, অনির্বাণ জোনাকি যেন। সে নিজেও তার হাতটাকে দেখতে পাচ্ছে না। সাকেন দারোগা মনে মনে ভাবে, কোনোদিনই নিজের শরীরটাকে দেখেনিÑবরং দেখেছে অন্যের শরীর। সে শরীরে লুকিয়ে আছে একটা অন্য রকম গন্ধ। রাত নামলে সে গন্ধ তীব্র হয়, রাত গভীর হলে সে গন্ধ সুতীব্র হয়ে ছোটে দিকবিদিক। হঠাৎ সাকেন দারোগার সে চিরচেনা গন্ধটা পায়। তার মনে, পাতলা, লোহা কালো নিটোল শরীরের থেকে আসছে অভাব মেশান এই গন্ধ… গোল্ড লিফ সিগারেটে একটা কড়া টান দিয়ে সে বলে, ‘কিডা?’, ‘আমি চ্ছার’, ‘অঃ তর হাতে চুড়ি নাই; চুড়ি পরস না ?’
চ্ছার, আপনার দুটো পায়ে পড়ছি ; মাঝিকে ছেড়ি দ্যান ; আমরা খুবই গরীব! ছার আমি সব বুঝি- আমাকে কি করতি হবে বলেন। ‘অন্ধকারে কলমী কণ্ঠস্বরটি কেমন যেন অন্য রকম লাগে। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সাকেন দারোগার চোখে অন্ধকার সহ্য হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কলমীও এখন দেখতে পাচ্ছে অন্ধকারের কালো মানুষটাকে। সাকেন দারোগা বলে, ‘মার্ডার কেস- অ্যাটেম্প টু মার্ডার’।
চ্ছার, আমরা গরিব চ্ছার; অত্ত বুজিনি“…খিক খিক করে কুৎসিতভাবে হেসে ওঠে দারোগা। তারপর, ‘মাগী তর ভারি দেমাগ; শালী দেমাগি শালী’, বলেই হাতের সিগারেটের শেষটা পায়ের চাপে পিষে ফেলে নির্মম নির্দয়ভাবে। আর তখনি কলমী যন্ত্রের মতো বলে, ‘আমাকে আপনি কুতাই নেবেন? চলেন; আর মাঝিরে ছাড়েন।’
চোখ সওয়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা কলমীকে সাকেন দারোগার জ্বলন্ত একটা সিগারেটের মতো মনে হয়। সে দেখতে পায় রাত ঘন হয়েছে। কাক্সিক্ষত সেই গন্ধটাও ছুটেছে রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে। ভীষণ ইচ্ছা করে এই সিগারেটে লম্বা টান দিতে। জগতের সবচেয়ে জঘন্য হাসি হেসে সাকেন দারোগা বলে, ‘দূরে না, ঐ ঘরে চল…’ যাওয়ার আগে সেন্ট্রিকে বলে, ‘ঐ খলিল ও চুদিরবাই রে একডা টিপসই নিয়া ছাড়ি দ্যাও।’ তারপর রাত গড়িয়ে চলে ঢিমে তালে; একাকী অসহায় চাঁদটা একই স্থানে স্থির হয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ…রাতজাগা পাখি ডানা ঝাপটে চলে অবিরাম। লাউয়ের কচি ডগাগুলো অশুভ ঝড়ের প্রবল দাপটে নেতিয়ে যায়; আর এর মাঝেই অসহায় চাঁদের কোণ থেকে একটা তারা খসে পড়ে নিঃশব্দে।
জালালুদ্দিন মাঝি দাঁড়াতে গিয়ে প্রথমে দাঁড়াতে পারে না। পা দুটো যেন তার কোমরের সাথে নেই। কলমীর ঘাড়ে হাত রেখে সে দাঁড়ায়। তারপর বলে, ‘কলমী তোর গা থেকি বিড়ির গ্যাস বেরুচ্চি; বিড়ি খেতি মন চাইচি।’ কলমী কথার উত্তর করে না। জালালুদ্দিন বলে চলে, ‘ঝড়ের দাপটে নাউয়ের কোচি ডগা ফুলান, সব নেতিয়ি গিচে বোল?’ ফাঁড়ির শিশির ভেজা ঘাসে পা রেখে জালালুদ্দিন আবার বলে, ‘আমাকে ধরলু ক্যানে, পেটালু ক্যানে আবার ছেড়ি দিলুই বা ক্যানে…ক্যানে রে কলমী?’ কলমী উত্তর করে না। সে এবার বলে, ‘দারোগা ছারডা ভাল লোক বল কলমী?’ চারদিকে গুমোট কাটিয়ে তখনই বয়ে যায় ঝির ঝির বাতাস। সেই বাতাসে চারপাশে জমাট অন্ধকার ওদের সারাগায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কলমী গায়ে মিশে থাকা বিড়ি-সিগারেটের লোভনীয় সুগন্ধ জালালুদ্দিন মাঝির নাকে ধাক্কা দেয়। সেই গন্ধে মাঝি ফাঁড়ির দূর্বার উপরে হড়হড় করে বমি করে দেয়।
অনেক কষ্টে বমির দমক সামলে জালালুদ্দিন ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, ‘শালার ঝড় থামলু তো রাত নামলু; সবকিছু ওলটপালট হয়ি গেল বোল কলমী।’
জালালুদ্দিনের মাথাটা নিজের দুর্গন্ধ শরীরের সাথে জড়িয়ে কলমী বলে, ‘ঝড় থেমিছে মাঝি, রাতের আঁধারও থাকবি না…কেটি যাবে…।’ শরীরের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে জালালুদ্দিন মাথাটা সরিয়ে নেয় এক ঝটকায়। তারপর আক্রমণ উদ্যত নেড়ি কুকুরের মতো দাঁত খিচিয়ে হিস হিস করে বলে, চ্ছার আর সোহাগ দ্যাখাতি হবে না, আমাকে ছুবিনি খানকী মাগী…শালী…।“
কলমী কোনো উত্তর দিতে পারে না; তার গলায় দলা পাকিয়ে আটকে আছে এক জনমের কান্না…।