ভাষা আন্দোলনে প্রথমবার সক্রিয় হয়েছিলেন বাংলাদেশি নারীরা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায়ে নারীদের অবদান অতুলনীয় ছিল। ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা আন্দোলনে নারীরা প্রথমবারের মতো সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সাহস, আত্মত্যাগ ও দৃঢ় প্রত্যয় প্রদর্শন করেন। পূর্বে নারীদের আন্দোলন ছিল লেখনীর মাধ্যমে। তবে ভাষা আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সমাজে একটি বিশেষ পরিবর্তনের সূচনা করে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর নারীরা লেখনীর মাধ্যমে আন্দোলনের অংশগ্রহণ শুরু করেন। সেই সময়ের নারী প্রজন্ম ‘বেগম পত্রিকা’ সহ বিভিন্ন মুখপত্রে প্রবন্ধ, চিঠিপত্র ও সম্পাদকীয় রচনার মাধ্যমে বাংলার ভাষা ও সাংস্কৃতিক মর্যাদার প্রশ্নে তাদের গভীর মনোভাব প্রকাশ করেন। মহেসনা ইসলাম, বেগম আফসারুন্নেসা এবং নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের মহিলা সংগঠনের সম্পাদিকা মিসেস রুকিয়া আনোয়ারের লেখাগুলোই এই সংগ্রামের নানা দিক প্রকাশ করে।
দেশ বিভাগোত্তর পরিস্থিতিতে যখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা স্মারকলিপি প্রদান করেন, তখন নারীদেরও সেই সংগ্রামে অমূল্য অংশগ্রহণ ছিল। স্মারকলিপিতে নারীদের স্বাক্ষর ছিল অধিকন্তু আনোয়ারা খাতুন, লিলি খান, লীলা রায় এবং রুকিয়া আনোয়ারের মত অসংখ্য সাহসী নারীর অবদান এ দাবিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এভাবেই নারীরা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু ছাত্রদের সংগ্রাম ছিল না। তাতে নারীদেরও অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মাধ্যমে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। তাঁদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুফিয়া ইব্রাহিম, শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন্নাহার ও সারা তৈফুর মত ছাত্রী বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে রাস্তায় নামেন।
ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের পরে নারীরা বিভিন্ন স্থানে সভার আয়োজন করে সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান। ২৩শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আজিমপুর কলোনির মেয়েরা প্রতিবাদের জন্য একত্রিত হন যেখানে কমলাপুর ও অন্যান্য দূরবর্তী এলাকা থেকে হাজার হাজার নারী যোগ দেন। ঢাকার ১২ নম্বর অভয় দাস লেনে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ পুলিশের গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে নারীদের একটি বৃহৎ সভার আয়োজন করা হয়। এই সভার একটি মূল প্রস্তাব ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি প্রদান।

ভাষার প্রতি নিবেদন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর, জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালি জাতির এই আত্মত্যাগ ও সংগ্রামকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই স্বীকৃতিস্বরূপ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এভাবে সেই বেদনা ও সংগ্রামের স্মৃতি শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয় বরং সারা বিশ্বের ভাষাপ্রেমীদের হৃদয়েও অমর হয়ে রয়ে যায়।
বাংলার ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষায় নারীদের লেখনী প্রচেষ্টা ও সরাসরি কর্মকাণ্ড যুগে যুগে প্রমাণ করে যে, তারা শুধু গৃহস্থালী জীবনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং সমাজ, রাজনীতি ও ভাষা আন্দোলনে তাদের অবদান অমূল্য ও স্মরণীয়। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত নারীরা সাহস, উৎসর্গ এবং একতার মূর্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের এই আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম আজও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায় এবং ভাষার মর্যাদা ও সাংস্কৃতিক ঐক্য রক্ষার লক্ষ্যে এক নতুন উদ্দীপনা প্রদান করে।