মেয়ে, সন্ধ্যার পরে বাইরে কী
নারীরা জীবনের বেশির ভাগ সময়জুড়েই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির ব্যবহার খুব একটা করতে পারেননি৷ স্বাধীনভাবে পোশাক নির্বাচন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা; সব কিছুতেই বাধাগ্রস্ত হন নারীরা। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে টেনে ধরা হয় তাদের লাগাম। আর এক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হয়, দিনের আলো কমে এলে ঘরের বাইরে থাকা নিয়ে।
দিনের আলো ফুরিয়ে এলে নারীদের জন্য ঘর থেকে ১০ পা সামনে এগোনোকেই যেন অন্যায় ধরা হয়। অন্ধকারই যেন নারীদের অদৃশ্য এক শত্রু। প্রকৃতির নিয়মে ঘড়ির কাঁটায় রাত ১০টা পুরুষদের সবেমাত্র সন্ধ্যা হলেও নারীর জন্য গভীর রাত।
বর্তমানে আমাদের দেশের শহরগেুলোর চিত্র কিছুটা ভিন্ন হলেও গ্রামাঞ্চলের চিত্র বেশ অনেকটাই করুণ। সন্ধ্যা নামার আগেই ঘরে ফেরা নারীদের জন্য একধরনের বাধ্যতামূলক কাজ৷ রাতের অন্ধকারে নারীদের বিরুদ্ধে হওয়া সব অন্যায়ের জন্য দায়ী করা হয় নারীকেই। তার দিকে ছুড়ে দেওয়া হয় একটি প্রশ্ন, ‘রাতে ঘরের বাইরে মেয়েদের কী?’
শহুরে এলাকাগুলোতে আজকাল নারীরা অনেকটা স্বাধীনভাবে রাতে চলাফেরা করলেও তাদের নিরাপত্তায় রয়েছে বিশাল ঘাটতি। প্রায় প্রতি রাতেই ইভটিজিং, হয়রানি, ধর্ষণের মতো ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে নারীদের। রাতের আঁধারে একজন নারীর উপস্থিতি টের পেলে যেন হায়েনার মতো হিংস্র হয়ে ওঠে বিকৃত মস্তিষ্কের একদল মানুষ। এসব চিত্র আমাদের প্রতিটি অলিগলিতে। রোজ গণমাধ্যমে যেসব ধর্ষণ, খুন, হয়রানির ঘটনা উঠে আসে, এর বেশির ভাগই ঘটছে রাতের। এক্ষেত্রে প্রশাসনও যেন বেশ ব্যর্থতার প্রমাণ দিচ্ছে৷
২০২১ সালের মে মাসের শেষের দিকে সাভারের আশুলিয়া সিঅ্যান্ডবি বাইপাস সড়কে একটি বাসে গণ-ধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী। তিনি ঘটনার দিন সন্ধ্যার হওয়ার কিছুটা পরে ‘নিউ গ্রাম বাংলা পরিবহন’ নামের একটি বাসে ওঠেন টঙ্গী যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পথে আশুলিয়া গরুর হাট এলাকার আগেই ওই বাসের অন্য যাত্রীদের নামিয়ে বাস আবার নবীনগরের দিকে নিয়ে যায় চালক। এরপর চলন্ত অবস্থায় বাসের দরজা-জানালা বন্ধ করে তাকে ধর্ষণ করে চালক-হেলপারসহ অন্যরা। রাতের অন্ধকারে ঘটা এ ঘটনায় দেশজুড়ে বেশ আলোড়নও ওঠে। তবে বরাবরের মতো থেমেও যায় সে আলোচনা।
কয়েকদিন ধরে সাভার এলাকার কিছু ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে। বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তার বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যার পর সাভার আমিন মডেল টাউনে ঘুরতে গিয়ে স্থানীয় বখাটেদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন। লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খুলতে চান না অনেকেই। তবে ঘটনাগুলো যখন কিছুটা সামনে আসছে, তখন বিভিন্ন গ্রুপে বলা হচ্ছে যেন ছাত্রীরা সন্ধ্যা ৬ টার পর হল থেকে কিংবা বাসা থেকে বের না হন। কে ধর্ষণ করলো, কেন করলো, তা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা খুব একটা নেই। সবাই সতর্ক করার নামে মেয়েদের সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছে সন্ধ্যা ছয়টা।
এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে অনেক রয়েছে। আমাদের চারপাশের বহু নারীই এসব ঘটনার শিকার হন। আর এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের জীবনে দিনের পর দিন স্বাধীনতা নামক শব্দটি ধোঁয়াশাই রয়ে যায়। সমাজ নারীদের ওপরই সব দায় চাপিয়ে বলে, ‘তুমি মেয়ে, তুমি সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরবে।’